মহিলা বিধবা। কোরা বা এমনি সাদা থান পরেন না কখনো। সর্বদাই তসরের বা মুগোর থান পরেন। এও সুবল মিশ্রর মুখে শোনা। কতজনে কত দামী তাঁতের থান এনে মাকে প্রণাম করে যায়। মা সে-সব গরিব দুঃখী বিধবাদের চুপিচুপি বিলিয়ে। দেন। এমনি থান পরতে দেখলেই নাকি তার ছেলের মুখ ভার হয়। অতএব ছেলের যেভাবে মাকে সাজিয়ে আনন্দ সেইভাবেই সাজেন তিনি।
ছেলের এই পছন্দের সঙ্গে আমি নিজেও দ্বিমত হতে পারিনি। সত্যিই এই বেশে ভারি সুন্দর দেখায় তাঁকে। সামনে এলে প্রথমেই মনে হয় না তিনি বিধবা। শুচিস্নিগ্ধ এই বেশ দেখলে দৃষ্টি প্রসন্ন হয়।
ওষুধপ্রার্থী আর উপদেশপ্রার্থীদের বিদায় দিয়ে তিনি আমার দিকে ফিরলেন। সকৌতুকে নিরীক্ষণ করলেন একটু। তারপর বললেন, হ্যাঁ, আছে তো গল্প, তুমি লিখবে?
আমি অপ্রস্তুত। সুবল মিশ্রর পুলকিত বদন। নামী ব্যারিস্টার ছেলের মুখে বিড়ম্বনা গোপনের প্রয়াস। তার স্ত্রীর মুখে কৌতুকব্যঞ্জনা।
মা আবার বললেন, সেদিন তুমি চলে যাবার পর বউমা বলছিল, লেখক হিসেবে তোমার নাকি খুব নাম-ডাক, তোমার অনেক গল্প-উপন্যাস ওর পড়া। এখন তো দেখছি ও ঠিকই প্রশংসা করছিল, দিব্বি চোখ আছে–গল্প যে আছে সেদিন একঘণ্টা এখানে বসেই তুমি বুঝলে কি করে?
তামাসা করছেন কিনা বোঝা গেল না, কারণ সুবল মিশ্রর মুখে মহিলাটির হাসি কৌতুকের গল্পও শোনা আছে। বললাম, আর লজ্জা দেবেন না।
তিনিও হেসে উঠলেন, লজ্জা কি, অনুভব করার মত চোখ আর মন আছে বলেই ধরে ফেলেছ–উল্টে বাহাদুরীর কথা তো! হাসিমুখে তিনি ছেলের বউয়ের দিকে তাকালেন একবার, তারপর আবার বললেন, ওই বউমাকে যদি ভালোমত ধরতে পারো, একটা গল্প পেয়েও যেতে পারো–তবে তোমাকে খুব সাবধানে লিখতে হবে, ও গল্প লিখতে না পারুক বাড়িয়ে বলতে ওস্তাদ।
ছেলের বউয়ের নাম ঊর্মিলা। বছর সাঁইতিরিশ-আটতিরিশ হবে বয়েস। ইনিও মন্দ সুশ্রী নন, তবে তার রূপবান স্বামীটির তুলনায় কিছুই নয়। কিন্তু ভদ্রলোকের তুলনায় অনেক বেশি হাসিখুশী। এই গুণেরও একটা রূপ আছে। শাশুড়ীর কথায় লজ্জা পেলেন হয়ত, কিন্তু ঠিক দেখলাম কিনা জানি না, তার দিকে চেয়ে একটা চাপা উদ্দীপনার আভাসও চোখে পড়ল যেন।
মায়ের হাসিমাখা দৃষ্টি এবারে ছেলের মুখখানা চড়াও করেছে।–ও কি! তোর মুখ অত গম্ভীর কেন? পাছে মায়ের ঠুনকো মর্যাদায় ঘা পড়ে সেই ভয়ে বুঝি?
এবারে ছেলে অপ্রস্তুত। হেসেই জবাব দিলেন, তোমার মর্যাদায় ঘা দিতে হলে এঁকে কলম ছেড়ে অন্য কিছু ধরতে হবে।
মা-টি ছদ্মগাম্ভীর্যে তক্ষুনি আমার দিকে ফিরলেন, থাক বাবা, তোমার লিখে কাজ নেই, কোর্টে কাড়ি কাড়ি মিথ্যের ব্যবসা করে তো ও আগে থাকতেই ওর বউকে চাটুর রাস্তায় চালাতে চাইছে, আর কানাকড়িও সত্যি পাবে না তুমি–এর পর বউমা বলে যদি কিছু, আমার কাছে যাচাই করে নিও।
.
ফেরবার পথে সুবল মিশ্র বলল, আমার কেমন মনে হচ্ছে, তুমি ঠিকই ধরেছ –মায়ের জীবনে কিছু একটা ব্যাপার আছে।
-মনে হচ্ছে কেন?
-মায়ের কথা শুনে আর ওই ছেলে আর ছেলের বউয়ের হাবভাব দেখে।
একটু বাদে নিজে থেকেই জানালো, মাকে এখানে স্কুলে সক্কলে ভালবাসে, ভক্তি করে, আপদে-বিপদে ছুটে আসে তার কাছে। মায়ের সর্বদাই হাসিমুখ আর সর্বদাই কিছু না কিছু কাজে ব্যস্ত। বিশেষ করে ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনী এলে তো কথাই নেই। যত হাসিখুশী তত ব্যস্ত।..কিন্তু একদিন মায়ের সে-এক অদ্ভূত মূর্তি দেখেছিল সুবল মিশ্র। কার মুখে শুনেছিল, মায়ের একটু জ্বর-ভাব হয়েছে। কিন্তু সমস্ত দিন দেখতে যাওয়ার ফুরসত মেলেনি। সময় হল রাত আটটার পরে। শীতকাল। তখন। ঘরের মধ্যেই হাড়ে-হাড়ে ঠোকাঠুকি, নেহাত দায়ে না ঠেকলে বাইরে কেউ বেরোয় না। কিন্তু সুবলের ভিতরটা কেমন খুঁতখুঁত করতে লাগল। তার পরদিনই বড় লেন-দেনের ব্যাপার আছে একটা। এর মধ্যে মায়ের শরীর খারাপ শুনেও যাওয়া হল না বলে খুঁতখুতুনি আরো বেড়েই গেল। শেষে আপাদমস্তক গরম পোশাকে নিজেকে মুড়ে, সাইকেল আর টর্চ নিয়ে বেরিয়েই পড়ল সে। মা যদি ঘুমিয়ে পড়ে থাকেন, খবরটা তো নিয়ে আসতে পারবে!
কিন্তু গিয়ে দেখে, বাড়িতে যারা থাকে তারাই ঘুমুচ্ছে–বাইরের ঘরে কম্বল মুড়ি দিয়ে একজন চাকর বসে। চাকরটা জানালো, মা তখনো পুজোর ঘর থেকে বেরোননি।
কি খেয়াল হল, পায়ে পায়ে সুবল ভিতরে ঢুকল। মায়ের বাড়িতে অন্দরমহল বলে কিছু নেই। ভিতরে আগেও দুই একবার এসেছে। পুজোর ঘরের দরজার এক পাট খোলা। গিয়ে যে দৃশ্য দেখল ভোলবার নয়। গোবিন্দজীর বিগ্রহের সামনে মা দুহাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ বোজা। সেই হাড়কাঁপানো শীতে মায়ের গায়ে একটা গরম জামা বা চাদর পর্যন্ত নেই। তসরের থানের আঁচলটা শুধু গায়ে। জড়ানো। কিন্তু মা যেন পাথরের মূর্তি। একটু কাঁপছেন না, একটু নড়ছেন না–নিঃশ্বাস প্রশ্বাসও নিচ্ছেন কিনা খুব ভালো করে লক্ষ্য না করলে বোঝা যায় না। সেই পাথরের মূর্তির দুই গাল বেয়ে অজস্রধারে. ধারা নেমেছে।
হতবুদ্ধির মত কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল সুবল মিশ্র খেয়াল ছিল না। কম করে আধঘণ্টা হবে। ঠায় দাঁড়িয়ে সেই এক দৃশ্য দেখেছে সে। মায়ের সমস্ত দেহে কোনো অনুভূতির লেশমাত্র নেই। কেবল ওই নীরব নিঃশব্দ কান্না ছাড়া। কেঁদে কেঁদে মা। বুঝি নিজেকে নিঃশেষে ক্ষয় না করা পর্যন্ত ওমনি চোখ বুজে হাত জোড় করে গোবিন্দজীর সামনে দাঁড়িয়েই থাকবেন।