মোহিনী সরকার জিজ্ঞেস করলেন, কলেজ আর লাইব্রেরি আছে তাতে কি?
–এরা থাকা মানেই সাহিত্যিক শিকারের ফাঁদ পাতা–সাহিত্য সভা-সাহিত্য মিটিং-হরি।
-আর এখন যদি আমরাই খবর দিয়ে দিই?
–প্রাণে মারা যাব। ওঁর (স্ত্রীকে দেখিয়ে) সেই মূর্তি আপনারা দেখতে পারবেন?
সোমা গাঙ্গুলি হাসতে হাসতে বললেন, বসুন, চা আনি।
মোহিনী সরকার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন দাঁড়ান!
নিজেই গটগট করে ভিতরের ঘরে ঢুকে মোড়াটা এনে পেতে দিলেন।-বসুন! এখানে চা নয়। যে ভাওতাবাজি ইনি আমাদের সঙ্গে করেছেন, আপনিও চুপ করে থেকে ওঁর অ্যাকসেসুরি হয়েছেন, তার জের আপনাদের সামলাতে হবে। আমার রায় আমি পরে দিচ্ছি। তাছাড়া আমার আবার না ডাক্তারের কাছে ছুটতে হয়, ইনি কে জানার পর আমার স্ত্রীর কথা বন্ধ হয়ে গেছে। যাক, আগে আপনি বসুন
নিজের চেয়ার টেনে নিয়ে আবার মহাদেব গাঙ্গুলির মুখোমুখি।–আপনার মিথ্যের ব্যবসাটা তাহলে এই?
মহাদেববাবু অম্লানবদনে সায় দিলেন। এই।
বিভা সরকারের এতক্ষণে জিভ নড়ল।–আপনি এত বড় স্রষ্টা বলেই নিজের সৃষ্টিকেও অনায়াসে মিথ্যে বলতে পারছেন।
মোহিনী সরকার মন্তব্য করলেন, বাঁচা গেল, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না। সোমাকে বললেন, ওঁর এখনকার কথার মধ্যে কেবল সুপারলেটিভ ডিগ্রিটা লক্ষ্য করে যাবেন!
সোমা হেসেই বললেন, আপনিও তো ওঁর পিছনে কম লাগেন না দেখি। উনি বুঝি গল্প-উপন্যাস পড়তে খুব ভালবাসেন?
-মুখ দেখে বুঝে নিন। তবে গল্পকার ও ঔপন্যাসিক মাত্র দুই একজনকে মারাত্মক ভালবাসেন। এখন আমিই ওঁকে নিয়ে কলকাতায় সরে পড়ব কিনা ভাবছি।
মহাদেব গাঙ্গুলি গুরুগম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, কি ভাগ্য–কি ভাগ্য!
মহিলারা দুজন কেবল হাসছেন। মোহিনী সরকার ভদ্রলোকের দিকে ফিরলেন।–এই বছর তিনেক আগে আপনাকে একবার কলকাতার রোটারি ক্লাবে আনা হয়েছিল?
একটু ভেবে মহাদেববাবু জবাব দিলেন, হয়েছিল।
–আপনি সেদিন অ্যাংরি জেনারেশন আর জেনারেশন-গ্যাপ সম্পর্কে বলেছিলেন?
আবারও ভেবে জবাব দিলেন, হবে…।
হবে না। আমি রোটারিয়ান, সেদিন উপস্থিতও ছিলাম। চেনা-চেনা মনে হতেও চিনতে পারি নি, কারণ উনি (সোমা) ঠিক কথাই বলেছিলেন–আপনার ওই অসুখ। আপনার কতটা খেয়ে দিয়েছে এখন বুঝতে পারছি। যাক, রোটারি থেকে ফিরে আমার স্ত্রীকে আপনার কথা বলতে উনি টানা তিন দিন অভিযোগ করেছিলেন, কেন কিছু একটা ব্যবস্থা করে তাকে নিয়ে যাওয়া হল না।
মহাদেব গাঙ্গুলি আবার বলে উঠলেন, ভাগ্য–ভাগ্য।
এবারে জোরালো অনুযোগের সুরে বিভা সরকার বললেন, কিন্তু আমাদের তো আপনি দুর্ভাগ্যের দিকেই ঠেলে দিয়েছিলেন। আপনার লেখা পড়ে মনে হয় মানুষের জন্য আপনার কত মমতা, কিন্তু নিজে কত নির্মম হতে পারেন তার প্রমাণ পেলাম। আজ এই খাম কটা ওঁর হাতে না পড়লে আমরা জানতেও পারতাম না কার সঙ্গে এত দিন ঘুরলাম বেড়ালাম কথা কইলাম। এ কথা মনে হতে এখন আপনার ওপর আমার রাগই হচ্ছে।
জবাবে মহাদেববাবু আবার একটা ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে শুধু বললেন, বেচারা খোকা গাঙ্গুলি।
গম্ভীর মুখের যে কৌতুক এতদিন এমনি ভালো লাগছিল এখন সেটা দ্বিগুণ ভালো লাগছে দুজনেরই। মোহিনী সরকার এবার হুকুমের সুরে সোমাকে বললেন, দশ মিনিট সময় দিলাম, এর মধ্যে রেডি হয়ে আসুন।
সোমা বললেন, দাঁড়ান, আগে চা হোক, ওঁরও এখন পর্যন্ত জোটেনি।
–নো টি! মোহিনী সরকারের বিচারের মুখ।-এখন আপনারা দুজনেই আমাদের আসামী–আমাদের খুশিমতো আমরা, আসামী ধরে নিয়ে যাব। চটপট রেডি হোন।
সোমাই জিজ্ঞেস করলেন, কোথায়?
-আগে ঠিক ছিল এখানে এসে আপনাদের নিয়ে বেড়াতে বেরুব। বেড়িয়ে আপনাদের আমার বাড়ি নিয়ে যাব, কারণ সেখানে আপনাদের রাতের ডিনার রেডি থাকবে
মহাদেব গাঙ্গুলি তার বলার মাঝে গুরুগম্ভীর আর্তনাদ করে উঠলেন, যাঃ কলা, এখন সেটা বাতিল নাকি?
বিভা সরকার হেসে উঠলেন। মোহিনী সরকার বললেন, না, আজ বেড়ানো বাতিল–এক্ষুণি আমাদের বাড়িতে আপনাদের হাজতবাস, রাতেও ফিরতে পারছেন কিনা সন্দেহ। স্ত্রীর দিকে ফিরে গলা খাটো করলেন, কেমন, জাঁদরেল লেখকের সঙ্গে কথাবার্তা সমান তালে হচ্ছে তো?
জবাব মহাদেববাবুই দিলেন, বললেন, বেশ হচ্ছে। কিন্তু নিয়ে গিয়ে তারপর উত্তরপ্রদেশ থেকে মধ্যপ্রদেশ পর্যন্ত শাস্তির ব্যবস্থাটা কেমন হবে?
প্রশ্নটা হঠাৎ না বুঝে মোহিনী সরকার থতমত খেলেন একটু। তারপর জোরে হেসে উঠলেন।–মুখ থেকে পেট পর্যন্ত শাস্তির ব্যবস্থা?… তা ভালোই হবে। ইংরেজি, বাংলা দুরকমেরই শাস্তির আয়োজন। মোচার কাটলেট পাবেন আবার চিকেন কাটলেটও পাবেন, ফ্রায়েড পোটাটো পাবেন ফ্রায়েড ফিশও পাবেন, ভাত পাবেন ফ্রায়েড রাইসও পাবেন, মাছের কালিয়া পাবেন চিকেন কারিও পাবেন, কাস্টার্ড পাবেন আবার রসগোল্লাও পাবেন
-ব্যস ব্যস ব্যস, আমি রসের অতলে মানে রসাতলে চলে যাচ্ছি! স্ত্রীর দিকে ফিরে তাড়া দিলেন, কই, ওঠো না শীগগির। এত শাস্তি কি একবারে সহ্য করতে পারব–এখন থেকেই শুরু হোক। শীগগির যাও, আর দেরি কোরো না।
.
বাংলোয় পা দিয়ে এইদিন মোহিনী সরকার সোজা তাদের শোবার ঘরে নিয়ে এলেন। সামনে বইয়ের তাকে তিনটে মোটা বই, আর তিনটে বিপুল আকারের পূজাসংখ্যা। তিনটে বইয়েরই লেখক মহাদেব গাঙ্গুলি। একটা শ্রেষ্ঠ গল্পের সংকলন, একটা লেখকের নির্বাচিত গল্পগুচ্ছ আর একটা হালের ছাপা পরিপুষ্ট আকারের উপন্যাস। এবারের ওই পূজাসংখ্যা তিনটেতেও মহাদেব গাঙ্গুলির তিনখানা উপন্যাস আছে। মোহিনী সরকার বললেন, তাহলে বুঝুন আমার গৃহিণীর হৃদয়ে আপনার জায়গাটি কোথায়।