বিভা সরকার হাসতেও পারছেন না, হাসি চাপতেও পারছেন না। সোমা গাঙ্গুলি সকৌতুকে স্বামীর গম্ভীর মুখের দিকেই চেয়ে আছেন। মোহিনী সরকার ধরে নিলেন, ব্রোকারি অর্থাৎ দালালি-টালালি হবে ভদ্রলোকের জীবিকা। মিথ্যের ফুলঝুরি ওই লাইনেই বেশি ছোটাতে হয়। তাই আর জেরার মধ্যে না গিয়ে তারিপ করলেন, আপনি তো ভাগ্যবান, অসং রাস্তা ধরেন নি-আমরা সত্যকে মিথ্যে করছি আর মিথ্যেকে সত্য বানাচ্ছি। যাক, এখানে আছেন কতদিন?
-জানি না। উনি যদি মনে করেন আমার শরীর ভালো যাচ্ছে তাহলে চট করে নড়া-চড়ার কোনো প্রশ্ন নেই। আপনারা?
-আপনার মতো অতটা না হলেও আমারও উনিশ বিশ একই ব্যাপার। দুবছর আগে একটু মাইলড স্ট্রোক হয়েছিল, সেই থেকে ওঁর বিবেচনায় খুব সুস্থ থাকছি না।
খোকা গাঙ্গুলি বলে উঠলেন, বাঃ এদিক থেকে আমরা তাহলে সতীর্থ।
বিভা সরকার এবারে উঠে দাঁড়ালেন, এখন চলো, অনেক জ্বালিয়েছি, আর না। খোকা গাঙ্গুলির দিকে ফিরলেন, আপনারা আমাদের বাড়িতে কবে যাচ্ছেন বলুন, অনেকক্ষণ সময় নিয়ে যেতে হবে–আর আপনি কি খেতে ভালবাসেন বলুন।
খোকা গাঙ্গুলি নিজের স্ত্রীর দিকে তাকালেন। দেখলে, কেবল তুমিই বলো কথার চোটে কান ঝালাপালা–কথার জাদু দেখলে? বিভার দিকে ফিরলেন, খাওয়ার ব্যাপারে আমি ভেজ নভেজ দুইয়েরই উপাসক-মোচার কাটলেট আর চিকেন কাটলেট দুইই সমান রেলিশ করে খাই। আপনি যেভাবে বলছেন, কাল যেতে পারি, পরশু যেতে পারি, তরশু যেতে পারি–আবার কাল পরশু-তরশু রোজই যেতে পারি।
বিভা সরকার হাসি মুখে মাথা নাড়লেন, বেশ তো যাবেন–এমন কান ঝালাপালার আশায় আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করব।
পরদিন না হোক, তার পরদিন সত্যিই এসেছেন তারা। সরকার-দম্পতি খুশির অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। আর ভদ্রলোকের গল্প জমাবার প্রতিভা দেখে এদিনও মুগ্ধ হয়েছেন। আর খোকা গাঙ্গুলি মুগ্ধ হয়েছেন এমন অল্প সময়ের মধ্যে খাওয়ার ব্যবস্থা। দেখে। সত্যি গরম চিকেন কাটলেট এসেছে, চমৎকার স্যালাড এসেছে, ফ্রায়েড পোটাটো এসেছে, শেষে পুডিংও। খোকা গাঙ্গুলি হাঁ করে খানিক দেখলেন। তারপর না হেসে সোল্লাসে বলে উঠলেন, আপনি একি জাদু জানেন–ঘাটশিলায় এই সব!
বিভা বললেন, আমার বাহাদুরি নেই, উনি বাইরে বেরুলে আমি সঙ্গে না থাকলেও চলে–পুরনো খানসামাটা না হলে চলে না–তাকে সঙ্গে আনাই চাই।
-খানসামা! আহা! সোমার দিকে ফিরলেন, দেখো, এবার থেকে ওঁদের আর কষ্ট করে আমাদের ওখানে যাওয়ার দরকার নেই, আমরাই যখন পারি এসে যাবখন।
বিভা খুশিমুখে রাজি।–আসবেন, ও জন্যে ঘাবড়াই না। স্বামীকে দেখিয়ে শোনালেন, উনি সেদিন বলছিলেন, ভদ্রলোকের কথা শুনলে আর তার সঙ্গে কথা বললে মনে হয় খানিকটা আয়ু বাড়ল। তবে এর পরে আপনার খাওয়ার ব্যাপারে আপনার মিসেসের মতামত নেব কিন্তু।
–নিশ্চয় নেবেন। সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর সায়।তবে দয়া করে আমার খাওয়ার আগে নয়, পরে।
খাওয়ার শেষে বড় করে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।–আঃ, আমারও পরমায়ু কিছু বাড়ল!… তবে আমাদের তফাৎ খুব নেই বুঝলেন, আমি খাই-খাই করে খাই আর উনি (স্ত্রীকে দেখিয়ে) ভালো জিনিস হলে খাই-না খাই-না ভাব দেখিয়ে খান।
সোমা গাঙ্গুলির পুডিং খাওয়ায় ছেদ পড়ল। হেসে ফেললেন।
বিভা তাড়াতাড়ি বললেন, আপনি খান তো। ভদ্রলোকের দিকে ফিরলেন, আপনি সব থেকে বেশি মজা পান দেখছি ওঁর পিছনে লেগে।
খোকা গাঙ্গুলির নিরীহ মুখ।-অন্যের পিছনে লেগে অত নিরাপদ বোধ করি না।
মোহিনী সরকার হা-হা শব্দে হেসে উঠলেন।–আপনাকে কথাশিল্পী বলি, না কথাসাগর বলি।
এই সামান্য কথায় সোমা গাঙ্গুলির বেশ একটু আনন্দ দেখা গেল। মন্তব্য করলেন, তাই বললে যদি একটু জব্দ হন।
আর এই সামান্যতেও খোকা গাঙ্গুলি দমে গেলেন।–অমন কাণ্ডটি করবেন না, শুনলে সাহিত্যিকের দল আপনাকে ঘেরাও করবে। যাক, ঘাটশিলায় বেড়ালেন কেমন?
বিভা জবাব দিলেন, এখানে ওই সরু পাথুরে সুবর্ণরেখা আর ওই ঢিবি ছাড়া বেড়াবার কি আছে–দেখারই বা কি আছে!
খোকা গাঙ্গুলি বললেন, সুবর্ণরেখার বিক্রম দেখতে হলে বর্ষায় আসবেন। মৌভাণ্ডারের কপার কর্পোরেশন তো মাত্র দেড় মাইলের মধ্যে–দেখে আসতে পারেন। …কপার মাইন অবশ্য মাইল ছয়েক হবে এখান থেকে, মোসাবাণী থেকে রাখা মাইনস পর্যন্ত চলে গেছে। সাইকেল রিকশ নিয়ে তা-ও ঘুরে আসতে পারেন। একটু থেমে আবার বললেন, এই ঘাটশিলাকে হেলাফেলা করবেন না-একদিন এই ঘাটশিলা ছিল। ধলভূমের রাজধানী। ধলভূম রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী রংকিণীর মন্দিরও দেখে আসতে পারেন–এই আশ্বিনেই সেখানে সাঁওতালদের বিন্দ মেলা হয়, টানা পনের দিন চলে –ওদের সব থেকে বড় উৎসব এখানকার।
সরকার-দম্পতি মন দিয়ে শুনছিলেন। বিভা সরকার বললেন, কিছুই তো দেখি নি এখনো… আপনি বুঝি অনেকবার এখানে এসেছেন?
খোকা গাঙ্গুলি তক্ষুণি মাথা নাড়লেন।-আমারও এখানে এই প্রথম, আর এখন পর্যন্ত সুবর্ণরেখা ছাড়া আর কিছুই দেখি নি।
তারা অবাক।–সে কি?
সোমা মুখ টিপে হেসে জবাব দিলেন, এটা মিথ্যে নয়, যেখানে যখন যান, আগে লাইব্রেরি থেকে বই আনিয়ে সে জায়গা সম্পর্কে খুঁটিয়ে পড়ে নেন।
অন্য দুজনের কৌতূহল স্বাভাবিক। মোহিনী সরকার জিজ্ঞেস করলেন, কেন, পরে দেখতে সুবিধে হয় বলে?