বিভা সরকারের চোখে কৌতুক, মহিলার অপ্রতিভ মিষ্টি মুখ। ভদ্রলোকের বাইরেটা একটু নির্লিপ্ত গম্ভীর বটে, কিন্তু কথা একটু কৌতুক-ছোঁয়া হেঁয়ালি গোছের। বিনীত জবাব দিলেন, আমার বলার মধ্যে একটু ভুল হয়েছে। বলা উচিত ছিল বাইরে দেখা হয়ে গেলে আমরা যাঁদের সেই ওঁরা।
জবাব শুনে তুখোড় চালাক মানুষ মোহিনী সরকার ভিতরে ভিতরে একটু হোঁচট খেলেন। অথচ কথাগুলো সঠিক বোধগম্য হল না। মহিলা তাড়াতাড়ি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, আপনারা বসুন, ওঁর কথায় কান দেবেন না।
বসার আগে মোহিনী সরকার বললেন, দাঁড়ান, আগে নিজেরা নিজেরা পরিচয় করে নিই। আমি মোহিনী সরকার, পেশা হাইকোর্টের ওকালতি-আর ইনি আমার স্ত্রী মিসেস সরকার–আপাতত প্র্যাকটিস অর্ধেকের বেশি ছেড়ে দিয়ে এঁর শাসনে আছি
ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, আ-হা, সুশাসন বলুন। নমস্কার, নমস্কার। আমার যে নামটা ইদানীং সব থেকে প্রিয় সেটা হল খোকা–যত বয়েস হচ্ছে এই নামের টান তত বাড়ছে। তাই আমি খোকা গাঙ্গুলি।
মোহিনী সরকার এবারে বুঝলেন, ভদ্রলোক বাইরে যেমনই হোক ভিতরে রসিক মানুষ। হাসিমুখে নিজেও তক্ষুণি একটু রসিকতা করে বসলেন, আপনাকে তাহলে খোকাবাবু বলে ডাকব?
নিশ্চয় ডাকবেন। একদিকে মিষ্টি, অন্যদিকে লোকে শুনলে মজা পাবে।
পরিচয় শেষ হবার আগেই থেমে যাবার উপক্রম দেখে একটু বেশি আগ্রহ নিয়েই। হয়তো মহিলাকে দেখিয়ে মোহিনী সরকার জিজ্ঞেস করলেন, ইনি…?
নির্লিপ্ত গম্ভীর গলায় খোকা গাঙ্গুলি বললেন, ইনি আমার ছোট শালী।
শোনামাত্র মোহিনী সরকার আর বিভা সরকার বিমূঢ়, হতচকিত। এটা বাইরের ঘর, যত বয়সই হোক শালী নিয়ে একঘরে…
– কিন্তু ভালো করে মাথায় কিছু ঢোকার আগেই ভদ্রলোকের উদ্দেশে মহিলার ধমক শোনা গেল।–কি হচ্ছে? মুখ লাল করে অভ্যাগতদের দিকে ফিরে সুন্দর দুখানা হাত জোড় করে বললেন, আমি মিসেস গাঙ্গুলি।
পলকে ঘর ছেড়ে পাশের ঘর থেকে একটা মোড়া নিয়ে এলেন।-বসুন আপনারা, আমি এতে বসি।
যে যার আসন নিলেন। সরকাররা দুজন কাঠের চেয়ারে, খোকা গাঙ্গুলি ইজি চেয়ারে। বসার পরেই মোহিনী সরকার অপ্রস্তুত। কারণ বসার ফাঁকটুকুর মধ্যে স্ত্রীর। দিকে চেয়ে তিনি একটা বিজয়ীর দৃষ্টি হেনেছেন, তারপর মুখ ফিরিয়েই দেখেন, ভদ্রলোকের নির্লিপ্ত দুচোখ তারই মুখের ওপর। চোখোচোখি হওয়ামাত্র খোকা গাঙ্গুলি আলতো করে জিজ্ঞেস করলেন, কি হল? আপনি জিতেছেন আর আপনার স্ত্রী হেরেছেন?
শুনে বরাবরকার স্মার্ট মানুষ মোহিনী সরকার হঠাৎ ভ্যাবাচ্যাকাই খেলেন একটু। –কি বলছেন?
–দাঁড়ান মশাই দাঁড়ান, না, মানে সবুর করুন। গম্ভীর মুখে ঈষৎ ভ্রূকুটি।–সেই প্রথম থেকে দেখছি আপনি আমার সোজা-সোজা কথাগুলোও বুঝতে পারছেন না। আচ্ছা, গোড়া থেকে একে একে বোঝাপড়াটা হয়ে যাক–
এ পর্যন্ত বলেই স্ত্রীর দিকে ফিরলেন।–এঁদের একটু চা দিতে বলো… আমি আধ পেয়ালার বেশি না।
সকোপে তার দিকে ফিরে তাকাতে গিয়ে মহিলা হেসে ফেললেন। অতিথিদের বললেন, আসলে এঁর দুবার হয়ে গেছে বলে আর সিকি পেয়ালাও জোটার কথা নয়–
ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় তাগিদ দিলেন, তাড়াতাড়ি। এঁদের সঙ্গে বোঝাপড়াটা শুরু করতে পারছি না।
মহিলা তক্ষুণি উঠে গেলেন। প্রথম পরিচয়পর্ব এমনি অভিনব যে সৌজন্যের খাতিরেও দুজনের কেউ চা থাক বলার ফুরসত পেলেন না। খোকা গাঙ্গুলি আধবসা থেকে তিন কোয়ার্টার শুয়ে পড়লেন। আর সেই ফাঁকে সরকার-দম্পতি বার দুই দৃষ্টিবিনিময় করে নিলেন। কাজের লোকটিকে চায়ের কথা বলে মিসেস গাঙ্গুলি এক মিনিটের মধ্যে ফিরে হাসিমুখে আবার মোড়ায় বসলেন।
মোহিনী সরকার ভিতরে ভিতরে বেশ কৌতুকবোধ করছিলেন। সপ্রতিভ মুখে। বললেন, খোকাবাবু এবারে বোঝাপড়া শুরু হোক–
খোকাবাবু আবার সোজা হলেন। কিন্তু অতিথির কথা কানেও গেল না যেন। স্ত্রীর দিকে ঝুঁকলেন, বেন্দাটাকে কি বলে এলে, আমাকে এই একটুখানি অন্তত দেবে তো? আঙুলে করে পরিমাণ দেখালেন।–না কি এঁরা খাবেন আমি বসে বসে দেখব?
সরকার-দম্পতি একটু জোরেই হেসে উঠলেন। মহিলার হালছাড়া হাসিটুকু আরো সুন্দর। বললেন, এই রকমই বলার স্বভাব, আপনারা ভাবছেন আমি ভালো করে খেতেই দিই না,
সঙ্গে সঙ্গে খোকা গাঙ্গুলির ভুকুটি এবং বিস্ময়।–সোমা! তুমি আর যা-ই করো, মিথ্যের আশ্রয় তো নাও না। ওঁরা ভাবছেন কি রকম? সামান্য একটু চা নিয়েই যা। ব্যাপার, বৃহৎ ব্যাপারে তুমি কি করো সে-কি এঁদের বুঝতে বাকি যে তুমি এঁদের অন্যরকম ভাবাতে চাইছ!
এ কদিনের দূর থেকে দেখা মানুষটার এমন রসের ফন্নধারা কল্পনা করা যায়। নি। তাদের বিশেষ জল্পনা-কল্পনা ছিল এই সোমা গাঙ্গুলিকে নিয়ে। সোমা নামটাও বেশ লাগল মোহিনী সরকারের। খোকা গাঙ্গুলি ছাড়া হাসছেন সকলেই। সোমা বললেন, লোকের সামনে আমাকে নাকাল করতে পারলেই ওঁর খুব আনন্দ।
মোটা ফ্রেমের পুরু কাঁচের চশমার ওধারে খোকাবাবুর দু চোখ এবার মোহিনী সরকারের মুখের ওপর।–কি বলছিলেন… বোঝাপড়া? হ্যাঁ, আমি বলছিলাম আপনি আমার জলের মতো কথাগুলোও বুঝতে পারছেন না। যেমন, এক–যেমন, আমরা আজ বেরুইনি কেন জিজ্ঞেস করতে আমি বললাম, আমার শরীরটা নাকি আজ ভালো নেই। ওই নাকি শুনে আপনি অবাক। অথচ একটু আগে আপনি নিজেই বললেন, প্র্যাকটিস অর্ধেকের বেশি ছেড়ে এখন স্ত্রীর শাসনে আছেন। সেই শাসনটা যদি আস্তে আস্তে নিখাদ সুশাসনের দিকে গড়ায় তাহলে দেখবেন আপনার শরীরের খবর আপনার। থেকে আপনার স্ত্রী ঢের বেশি রাখেন।