কাঁপতে কাঁপতে বোধহয় কথা শেষ করতে পারেন না ছোট দারোগা। কিন্তু যা বলা হয়েছে। তাই তো যথেষ্ট, উৎফুল্ল উত্তেজিত দুই বীর সতেজে এগিয়ে আসে।
আসে, কিন্তু মুহূর্তে পাথরের দেয়াল বনে যায়। এমন কি পাগলাটাও।
দরজার পাশ থেকে একেবারে এই ভোলা উঠোনে চলে এসেছে সেই চওড়াপাড় শাড়ির আঁচল। আর সে আঁচল বাতাসে এত উড়ছে বলেই আঁচলের অধিকারিণীর মুখ মাথায় আবরণ দেবার দায়িত্বটা ভুলে গেছে। সেই নিরাবরণ মুখ থেকে স্পষ্ট আর তীব্র একটি কণ্ঠস্বর যেন ছুরির ফলার মত বেরিয়ে আসে।
কষ্ট করে আর অত বোঝাবার দরকার কী? যা বোঝবার তা তো ওরা বুঝেই নিয়েছে। মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলার পর আর কী করতে হয়, সে কী ওদের অজানা? কি গো বাবারা? জানা নেই?
এই ঘৃণা আর বিদ্বেষে ভরা হিংস্র মুখটা যেন সমস্ত পরিবেশটাকেই পাথর করে দেয়।
বাবারা স্তব্ধ নিস্পন্দ। কিন্তু তাদের বাবা? বোধ করি বরদাস্তর সীমা ছাড়ায় বলেই পাথর হয়ে যাওয়া পরিবেশটাকে ফাটল ধরিয়ে গর্জন করে ওঠেন, তুতুঃ তুমি কিঃ কিঃ করতে এখানে? ভেঃ ভেঃ ভেবেছো কীঃ তুমি? যাও যাঃ ও ভেতরে।
তুমির মুখে আরও হিংস্র হাসি ফুটে ওঠে, না গেলে? আমারও ধোলাইয়ের ব্যবস্থা হবে? তা হয় তোক।
ফিরে দাঁড়ান পাগলাটার দিকে, স্থির গলায় বলেন, তা তোমায় এই আজ বলে দিচ্ছি বাপু। এদের হাত থেকে বেঁচে যদি বাড়ি ফেরো–তো ছেলে খুঁজতে আর এসো না। এ পৃথিবীর কোনোখানেই খুঁজে পাওয়া যাবে না তাকে। বুঝতে পেরেছ?…আর এসো না।…এই ছোট দারোগাবাবু তাকে সেই রাত্তিরেই–ঘটনাটা কী ঘটেছিল রঘু? তুমি তো ছিলে। শুধু রগের ওপর একটা থাপ্পড়, তাই না? তাতেই
গণেশ অবাক হয়ে ওই মুখটার দিকে তাকায়। জীবনে অনেক হিংস্র মুখ দেখেছে গণেশ, কিন্তু এরকম কি দেখেছে কখনও?
গণেশের চোখের সামনে থেকে একটা ঝাপসা পর্দা সরে যায়।…ওঃ এই তাহলে সেই দারোগার উপর দারোগা। ঘরের লোকের হাতেই মরণবাণ, তাই দারোগাবাবু এমন নখ-দাঁতহীন। ফাঁস হয়ে যাবার ভয়। অবিশ্যি ফাঁস হয়ে গেলেই যে ফাঁসির দড়ি গলায় উঠবে সে ভয় নেই! সামান্য মানুষ চৌকীদার, তারই ওঠে না, তা ওপরওলাদের।…তবে ফ্যাসাদ তো আছে।
ঘরের লোক ফাঁস করে দিল।
কী লজ্জা। কী লজ্জা!
ওপরওলার মুখের দিকে তাকাতে পারে না গণেশ, ভয় হচ্ছে আগুনের মালসাটা বুঝি ভেঙে ছত্রখান হয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে। অথবা এই লোকটাই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে–
পাগলে কী না করতে পারে।
দুজনে দুদিক থেকে শক্ত করে চেপে ধরবার জন্যে আলগোছ হয়ে থাকে।…কিন্তু আশ্চর্য, কোন দিকে কিছু হয় না।
জায়গাটায় যেন বোবায় ধরেছে।
লোকটা ফ্যাল ফ্যাল করে একবার ওই মুখটার দিকে তাকায়, যে মুখটা থেকে এখনি একটা অমোঘ বাণী উচ্চারিত হল।…তারপর হঠাৎ দু হাতে মাথা চেপে হাউ হাউ করে কেঁদে চেরা ফাটা গলায় বলে ওঠে, দারোগাবাবু তো তারে মারেন নাই মা ঠাকরোণ, সে তো আমার ছেলে। আমি যে আমার জলজেবন্ত ছেলেডারে বুকের মদ্যি ভরে রেখে দিন গুজরোছেলাম। আপনি আমার সেই আস্তো ছেলেডারে এককোপে খুন করে ফ্যালালে গো
কোনও দিকে তাকায় না, হনহনিয়ে চলে যায়।
কারুর মনে পড়ে না ওকে ধরা দরকার ছিল।
কিন্তু গণেশ চৌকীদারের কী সম্পর্ক এ ঘটনার সঙ্গে? সে কেন হঠাৎ নিজের চালাঘরের কোণে গিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে বসে?