- বইয়ের নামঃ আমি একটা মানুষ নই
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
আমি একটা মানুষ নই – আশাপূর্ণা দেবী
একটা মাঝারি সাইজের সুটকেসের মধ্যে নেহাৎ দরকারি, বলতে গেলে অপরিহার্যই কয়েকটা জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিল স্বাতী। একটু যেন বিপদেই পড়ে যাচ্ছে। অপরিহার্যর সংখ্যাও যে এত তা তো আগে খেয়াল হয়নি।
কিন্তু কী নেবে, কী নেবে না?
অরিন্দমের দেওয়া নয়, অথবা অরিন্দমের পয়সায় কেনা নয়, এমন জিনিস কটা আছে স্বাতীর? কোথায় আছে? মাঝে মাঝে মা বাবার উপহার কিছু দামী দামী শাড়ি। আর কী?
হঠাৎ মনটাকে ঝেড়ে ফেলে। ঠিক আছে, এতদিন ওর সংসারে আমি যে সার্ভিস দিয়েছি, তার জন্যে আমার কিছু পারিশ্রমিকও প্রাপ্য নেই কি?
মনে এই জোর নিয়ে আরো দুচারটি জিনিস টেনে বার করল আলমারি খুলে। এই সময় অরিন্দম এসে ঘরে ঢুকল। হৃত চেহারা, মুখের রংটায় যেন কালির পোঁচ।।
টাইটা খুলে মাটিতে ফেলে দিয়ে বিছানার ধারে বসে পড়ে ভাবশূন্য গলায় যেন প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলল, তবু এতদিন আমরা প্রেস্টিজের ওপরই ছিলাম। এবার সকলের সামনে উলঙ্গ হয়ে গেলাম।
স্বাতী আলমারির পাল্লাটা দুম করে বন্ধ করে দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, হ্যাঁ, কুষ্ঠগ্রস্ত শরীরটাকে শাটিনের পোশাকে ঢেকে রাখা হচ্ছিল। সেটা আর কতদিন চলতে পারে?
কুষ্ঠগ্রস্ত! কী অনায়াসে উচ্চারণ করল স্বাতী!
অরিন্দম উঠে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল।
রাস্তায় আলোর সমারোহ। আশেপাশে সামনে পিছনে কাছেদূরে অজস্র বাড়ি, অজস্র ফ্ল্যাট। সব জানলা দিয়েই আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে।
অরিন্দম মনে মনে বলল, ওরা সবাই সুখী। ওদের কারো শরীর কুষ্ঠগ্রস্ত নয়। আবার হঠাৎ হাসি পেল। আমারও সব ঘরের জনলায় জনলায় তো আলোর জোয়ার। ওরা কি বুঝতে পারছে এখানে কী গভীর অন্ধকার নেমে এসেছে।
অরিন্দম আবার জানলা থেকে সরে এসে খাটের ওপর বসে পড়ে। আস্তে বলে, আচ্ছা, স্বাতী!
স্বাতী কোনো উত্তর দেয় না। অরিন্দম একটু হাসির মতো গলায় বলে, ভাবছিলাম, হঠাৎ মনের জোর করে ভাবতে পারা যায় না, আমরা ঠিক আছি। আমাদের কোথাও কোনো ব্যাধির ছাপ পড়েনি।
স্বাতী মুখটা বাঁকায়। তেতো গলায় বলে, অনেক কাল সে মনের জোর দেখাবার চেষ্টা করেছিল। এখন সেই ঠাট অসহ্য হয়ে উঠেছে। ওসব তো অনেক হয়ে গেছে। সবেরই একটা সীমা আছে।
অরিন্দম স্বাতীর কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়।
বলে, বলার আমার মুখ নেই স্বাতী। তবু খুব বেহায়া বলেই বলছি, আর একটি বারের জন্যে কি আমায় একটু চান্স দিতে পারা যায় না?
দোহাই তোমার।
স্বাতী তীব্র তীক্ষ্ণ গলায় বলে ওঠে, আর এইসব নাটক করতে এসো না। রেহাই দাও আমায়। মনে রেখো আমি একটা রক্তমাংসের মানুষ!
অরিন্দম চুপ করে গেল।
স্নানের ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। আর ঢুকেই একটা অদ্ভুত কাজ করে বসল। ঠাস ঠাস করে নিজের গালে গোটাকতক চড় মেরে চাপা আর্তনাদের গলায় বলে চলল, কেন? কেন? ইডিয়ট রাস্কেল, হতভাগা বাঁদর, কেন? কেন?
অরিন্দম স্নানের ঘর থেকে ফিরে এসে দেখল সুটকেসের ডালাটা ভোলা। স্বাতী জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাতীও হয়তো অন্য সবাইয়ের আলোয় ভাসা জানলাগুলো দেখছে।
অরিন্দমের ফিরে আসাটা অনুভব করে স্বাতী ফিরে দাঁড়িয়ে ব্যঙ্গের গলায় বলল, ইচ্ছে হলে সুটকেসটা সার্চ করতে পারো। খোলা আছে।
স্বাতী! ছিঃ!
এর মধ্যে ছিঃ-র কিছু নেই। ভাবতে পারো বেশ কিছু গুছিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছি। ব্যাঙ্কের পাশবইটই সব যেখানে থাকবার রইল। আর–
থাক স্বাতী। এসব কথা থাক এখন।
ক্লান্ত ক্লিষ্ট গলায় বলল অরিন্দম, ঝিলিক কোথায়?
এসময় কোথায় থাকে? মাস্টারমশাইয়ের এখনো যাবার টাইম হয়নি।
ওঃ। টাইম?
তারপর স্বগোতোক্তির মতো বলল অরিন্দম, কাল থেকে?
স্বাতী নিষ্ঠুর গলায় বললল, সে নিয়ে না ভাবলেও চলবে তোমার।
স্বাতী কি এই নিষ্ঠুরতার জোরে নিজেকে শক্ত রাখতে চায়? নাকি নিজের দিকের পাল্লাটা হঠাৎ হালকা হয়ে যাবার ভয়ে বাড়তি বাটখারা চাপাতে চায়? তা নইলে অরিন্দম যখন বলে ফেলে, ওর সম্পর্কেও কিছু ভাববার অধিকার নেই আর আমার?
তখন স্বাতী মুখটা এত বিকৃত করে বলে ওঠে কেন, না, নেই। একটা বেহেড মাতাল লুজ ক্যারেক্টার জুয়াড়ি বাপের সে অধিকার থাকে না।
অরিন্দম আর কিছু বলে না। ঘর থেকে বেরিয়ে সরু ব্যালকনিটায় গিয়ে দাঁড়ায়। অনেক নিচে রাস্তা। এ ফ্ল্যাটটা পাঁচতলায়।
একদিন মাঝরাত্তিরে স্বাতী এখান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেষ্টা করেছিল। অনেক চেষ্টায় নিবৃত্ত করা গিয়েছিল সেদিন।
অরিন্দম যেন নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হচ্ছে। আমি কি একটা জানোয়ার? বকলস বাঁধা কুকুর একটা? তাই ‘অজন্তা’ নামের সেই মোহিনী নারীর সামনে গেলেই অনায়াসে সে বকলসটায় শেকল পরিয়ে আমায় যথেচ্ছ চালিয়ে নিয়ে বেড়াতে পারে?
হঠাৎ সীতেশের ওপর অসম্ভব একটা রাগে থরথরিয়ে উঠল অরিন্দম। সীতেশকে ও খুন করবে। সীতেশকে ও-হা, সবটাই সীতেশের বদমাইশি। বৌকে দিয়ে ফাঁদ পাতিয়ে জুয়ার আড্ডা বসিয়ে বন্ধুদের সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে।
উঃ। স্বাতী যদি আর একবারের জন্যে অরিন্দমকে চান্স দিত।
দেবে না। স্বাতী এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে।
তবু চেষ্টা করা যায় না?