- বইয়ের নামঃ আসল বেনারসী ল্যাংড়া
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
আসল বেনারসী ল্যাংড়া
আসল বেনারসী ল্যাংড়া
সীমা ঘরবার করছিল।
অফিস থেকে ফিরতে এত দেরি হচ্ছে কেন প্রতুলের!
যানবাহনের দুর্গতিতে দেরিটাই অবশ্য স্বাভাবিক হয়ে গেছে আজকাল, তবু ভাবনা না হয়েও পারে না। ওই যানবাহন থেকে দুর্ঘটনার নজীরও তো কম নেই।
সীমা অনেকবার চেষ্টা করেছে একটা পড়ে থাকা সেলাই নিয়ে বসতে। কিন্তু পারছে না। মন বসছে না। হাতের কাজ হাত থেকেই নামিয়ে বারে বারেই রাস্তার ধারের বারান্দায় এসে দাঁড়াচ্ছে। এবং আপন মনেই নানা মন্তব্য করছে।
যথা
কী হল রে বাবা, ব্যাপারটা কী? পাড়ার প্রায় সব ভদ্দরলোকেরাই তো এসে গেল একে একে। রাস্তা তো ক্রমশই ঝিমঝিমে হয়ে আসছে।…যা দিনকাল, জানি না কী ঘটছে। হে মা কালী, রক্ষা কর! যেন বিপদআপদ না হয়।
একবার এদিকে গলা বাড়িয়ে ডাক দিল, খুকু, কটা বাজল, দে তো আর একবার।
অলক্ষ্য কোনোখান থেকে খুকুর ঝঙ্কার ভেসে এল, নটা চব্বিশ! এই নিয়ে কবার হল মা?
সীমা ক্ষুব্ধ বিরক্তিতে বলে, ঠাট্টা করছিস? তা করবি বৈ কি? ঠাট্টারই সম্পর্ক তো? তোদের এ যুগের মনপ্রাণ বলে তো কিছু নেই! ভাবনা করছি আমি সাধে? কী রকম দিনকালটি পড়েছে? বাসে-ট্রামে লোক চলেছে যেন বাদুড়ঝোলা হয়ে! বিপদআপদ ঘটতে পারে না?
খুকু যেখানে ছিল সেখান থেকে একটু সরে এসে বলে, বিপদ-টিপদ তো দৈবের ঘটনা মা! তোমাদের সে যুগের ওই মনপ্রাণ খানি নিয়ে বসে বসে দুর্ভাবনা করলেই সেটা বন্ধ করতে পারবে? সব সময় খারাপটাই বা ভাবতে বসো কেন? সেটা বুঝি অপয়া নয়?
হয়েছে, আমায় আর জ্ঞান দিতে হবে না তোমাকে। রাত্তির দশটা বাজতে চলল, বাপ ভাই দুটো মানুষই রাস্তায় অথচ মেয়ের
খুকু বলে, তুমি যে অবাক করলে মা! ভাই আবার কবে রাত এগারোটার আগে আড্ডা সেরে বাড়ি ফেরে? দেখ গে কোথায় কোন্ পাড়ায় মোড়ের মাথা আলো করে দাঁড়িয়ে রাজকার্য চালাচ্ছেন তোমার পুত্ররত্ন।
সীমা আক্ষেপের নিশ্বাস ফেলে, তা জানি। তার জন্যে তো এক্ষুনি ভাবতে বসছি না। যে মানুষটা আড্ডা-ফাল্ডার ধারও ধারে না, তার জন্যে ভাবনা হবে না?
খুকু নরম গলায় বলে, সে তো ঠিক। কিন্তু পরশু না তরশুও বাবার এরকম দেরি হয়েছিল।
মোটেই এত নয়, সীমা প্রতিবাদ করে ওঠে, সেদিন মোটে নটা দশ হয়েছিল।
খুকু হেসে ওঠে, ওরে ব্যস্! একেবারে মিনিট সেকেণ্ডের কাটাটা পর্যন্ত মুখস্থ! কী সাংঘাতিক পতিব্রতা হিন্দু নারী!
বাজে বকবক করিস না খুকু। এই মানুষটাই আমায় পাগল করবে।
খুকু হি-হি করে, করবে? ওটা এখনও ফিউচারে আছে?
সীমা রেগে বলে ওঠে, খুকু! যাও! তুমি যেমন তোমার গল্পের বইয়ে মুখ দিয়ে পড়েছিলে, তাই থাকো গে যাও। উঃ! দিন দিন এত বাঁচালও হয়ে যাচ্ছিস–ওই য্যাঃ! গেল! কারেন্ট চলে গেল! ও মাগো! একে মরছি ভেবে ভেবে, আর এখন আলোটাও নিভে গেল!
খুকু রোষভরে বলে, তা যাবে না? আমার গল্পের বই পড়ায় অত নজর দেওয়া! গল্পের বই পড়ব না? ওর জোরেই তো বেঁচে আছে মানুষ!
খুকু থাম তুই! অত কথা ভাল লাগছে না!
খুকু (নেপথ্যে)–নাঃ! অবস্থা আয়ত্তের বাইরে। ভাবছিলাম কথা কয়ে মনটা একটু ইয়ে করে রাখি। বাবাকেও বলিহারি! এই ছিচকাঁদুনী গিন্নীটিকে তো চেনোই বাবা। গাড়ি না পাও, পায়ে হেঁটেও চলে আসা উচিত!..গলার স্বর তুলে বলে, মা, এই অন্ধকারে তো কিস্যু হবে না, বরং ট্রানজিসটারটা খুলে দিই গান শোনো। চিত্তচাঞ্চল্যের মহৌষধ
ফট করে ছোট্ট ট্রানজিসটারটা খুলে দিল।
এটাই তো এখন ভরসা।
লোডশেডিং-এর কল্যাণে রেডিও তো এখন প্রায় বাতিল আসবাবপত্রের সামিল হয়ে গেছে।
গান গেয়ে উঠলেন কোনও নামকরা গায়িকা, চাঁদ উঠেছিল গগনে, দেখা হয়েছিল তোমাতে আমাতে, কী জানি কী মহালগনে।
সীমা ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে, খুকু, ক্ষ্যামা দিবি?
খুকু চট করে বন্ধ করে দিল যন্ত্রটা। সেও কড়া গলায় বলল, উঃ! বাবা বাবা! যে লোক গান সহ্য করতে পারে না, সে মানুষ খুন করতে পারে।
খুকুর কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দরজায় ধাক্কা শোনা গেল। কারেন্ট অফ্, দরজার ইলেকট্রিক বেল অকেজো। অতএব সেই আদি ও অকৃত্রিম দুয়ারে করাঘাত।
ওই এসেছেন– খুকু দরজা খুলতে গেল।
সীমা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, থাক আমি দিচ্ছি।
ফ্ল্যাটবাড়ি, দরজা খুলতে অধিক দূর যেতে হয় না। প্রথম দর্শনের অভিব্যক্তিটা নিজের এন্ডারে থাক।
দরজা খুলে দিয়েই সীমা বিচলিত গলায় বলে উঠল, তুই! তুই এক্ষুনি?
পিন্টু ওরফে পল্লব দুই হাত উল্টে বলে, টাইমের একটু আগে এসে পড়েছি বটে মা-জননী! তা দেখে এমন হতাশ হয়ে যাবে তা তো ভাবিনি!
সীমা চড়া গলায় বলে, ছেলের কথার ছিরি শোনো। তোকে সকাল সকাল আসতে দেখে আমি হতাশ হলাম?
কি জানি, তাই যেন মনে হল!
সীমা চড়াগলায় বলে, ঘড়ির কাটা এগারোটা না ছাড়ালে তো আসতে দেখি না—
পিন্টু হেসে উঠে বলে, কিন্তু দেখো–এগারোটা! বারোটা বাজেইনি কোনও দিন।…এই যাঃ…খুকু টর্চটা আন তো একবার, পকেট থেকে কী পড়ে গেল মনে হল
দাদার গলা পেয়ে খুকু প্যাসেজের এদিকে বেরিয়েই আসছিল, এখন টর্চটা নিয়ে এল। বলে উঠল, কী রে দাদা, সূয্যি আজ কোন্ দিকে উঠেছে? তুই এক্ষুনি বাড়ি ফিরলি তোর প্রাণের আচ্ছাদারদের অনাথ করে?