নতুন কথা পাবে কোথায়? পেটে বোমা মারলে ক বেরোবে?…রোজ সকালে এই একঘেয়ে কথা শুনতে শুনতে গণেশের ইচ্ছে হয় ওই শিরফোলা গলাটা টিপে দিয়ে জন্মের শোধ আওয়াজ ঘুচিয়ে দেয়, কিন্তু হবার জো নেই সেটা।…ছোট দারোগা যে কালার পার্ট প্লে করে তখন। …অনেকক্ষণ হয়ে গেলে তবে গণেশ আর রঘুকে হাঁক পেড়ে বলে, এই, পাগলাটাকে ধরে শেয়াল কুকুরের মুখে ফেলে দিয়ে আয় তো।
তবে কাল পরিস্থিতি অন্যদিকে গড়িয়ে ছিল।
আজ আবার এই।
গণেশ বিস্ফারিত চোখে বলে উঠল, অ্যাঁ কী বললি?
লোকটা সে কথার জবাব না দিয়ে হনহনিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, গণেশ পিছন থেকে তার ঘাড় চেপে ধরল। কড়া গলায় বলে উঠল, যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা?
লোকটা ঝটকা মেরে ঘাড় ছাড়িয়ে নিতে যায়, পারে না, ঘাড় ঘুরিয়ে ঘাড় ধরা হাতটায় দাঁত বসাতে চেষ্টা করে, পেরে ওঠে না। অতএব আকাশ ফাটিয়ে একটা চীৎকার করে ওঠে। জান্তব চীৎকার। একমাত্র পাগলের স্বরযন্ত্র দিয়েই এমন অমানুষিক শব্দ বেরোনো সম্ভব।…
এই শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ছোট দাবোগার সেই ছাল ওঠা ইটের তৈরি বেঁটে একতলা বাসাটার আলকাতরা প্রলেপ দেওয়া দরজাটা খুলে যায়। গণেশ আশান্বিত চিত্তে তাকায়। মুহূর্তে কল্পনা করে নেয় বন্দুক হাতে বেরিয়ে আসছে দারোগাবাবু, নিদেন পক্ষে শঙ্কর মাছের ল্যাজের চাবুকটা। কিন্তু এটা কী হল? দরজাটা খটাং করে খুলল কে? গণেশ যদি দিনে কানা হয়ে ভুল না দেখে থাকে তো পষ্ট দেখতে পেল একটা চওড়া পাড় শাড়ির আঁচলের কোণ।…
তার মানে দারোগা গিন্নী।
কিন্তু সে ওই চকিতের মত।
পরক্ষণেই প্যান্টের বেল্ট আঁটতে আঁটতে দারোগাবাবুই বেরিয়ে আসেন। গণেশের মনে হয়, এখুনি একটা প্রলয় কাণ্ড ঘটে যাবে। আকাশ থেকে চন্দ্র সূর্য খসে পড়বে, শব্দ তাণ্ডবে বুক কেঁপে উঠবে।
প্রত্যাশার পাত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গণেশ।
কিন্তু কোথায় কী?
কোথায় সেই প্রলয়ঙ্কর গর্জন!
বেল্ট আঁটতে আঁটতেই গণেশকে বলে ওঠেন দারোগাবাবু, অ্যাই কী হচ্ছে? ঘাড় ছাড়।
ছাড়!..
অতএব ছাড়তেই হবে। মনের ঘেন্নায় মনে হয় গণেশের চাকরীটাই ছেড়ে দেবে। এই আলু ভাতের চাকরী আর নয়।
দারোগাবাবু, এখন যথারীতি মিঠেকড়া গলায় প্রশ্ন করেন, আবার এসেছিস আজ? কী বলেছিলাম কাল?
উঃ। কী অসহ্য, কী অসহ্য।
ঘাড় ছেড়ে দিতে বলায় যতটা না অপমানাহত হয়েছিল গণেশ তার চারগুণ আহত হল দারোগাবাবুর এই খাদে নামা কণ্ঠস্বরে। গণেশ হেঁট মুণ্ডে দাঁড়িয়ে থাকে।…কিন্তু কানটা তো হেঁট করা যায় না? তাই কানে এসে ঢোকে আপনি আমার ছেলে খুঁজে এনে দাও, আর আসবনি।
বন্ধ দরজার এপিঠে দাঁড়িয়ে পুলিশ নামক একটা অশরীরী আত্মাকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে তুই তোকারি করা যায়। কিন্তু সামনে দাঁড়ানো জলজ্যান্ত ব্যক্তি মানুষটাকে কি আর তা করা যায়? লোকটা তাই এখন আপনি দিয়েই আবেদন জানায়, আপনি আমার ছেলে খুঁজে এনে দ্যাও, আর আসবনি।
দারোগা ক্রমশ ধৈর্য হারান, ফের সেই একঘেয়ে কথা, হারামজাদা শুয়োরের বাচ্চা। তোর ছেলে আমায় বলে কয়ে হারিয়ে গেছে? তাই তাকে খুঁজে এনে দেব?
পাগলের মাত্ৰাজ্ঞান থাকে না, তাই সেও সমান গলা চড়ায়, মুখ খারাপ করবেনি বাবু। যা বলবে ভদ্রলোকের মতন বলে।
কী? কী বললি? পাগল ছাগল বলে ছেড়ে দিই বলে বড় বাড় বেড়েছে না? এখনও বলছি ভাল চাস তো বেরিয়ে যা। নইলে–
নইলে?
লোকটা ঘৃণায় মুখটা বিকৃত করে বলে ওঠে, নইলে গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে নেবে। জুতিয়ে মুখ ভেঙে দেবে, নোয়া পুড়িয়ে পুড়িয়ে গালে ছ্যাকা দেবে, কাপড় খুলে নিয়ে পিটোবে এই তো? তা কর। কিন্তুক ছেলে আমার চাই-ই চাই।
গণেশ অবাক হয়ে দ্যাখে রাগে অপমানে ছোট দারোগার সর্বাঙ্গ কাঁপছে, চোখ দিয়ে আগুন ছিটকোচ্ছে, তবু ছোট দারোগা কেন কে জানে নিজেকে সামলাচ্ছে।…ছোট দারোগার খোলা দরজার আড়াল থেকে মাঝে মাঝে যে একটা চওড়া পাড় শাড়ির আঁচল বাতাসে উড়ে উড়ে এক একবার দৃশ্যমান হচ্ছে, সেটাই কি কারণ? কিন্তু ওটা তো দারোগার পিছন দিকে। কই পিছন পানে তো তাকাচ্ছে না বাবু!
তাকাচ্ছে না, তবু মনে হচ্ছে বুঝি তাকাচ্ছে, আর তাকাচ্ছে বলেই নিজেকে সামলাচ্ছে। আবার গলা নামিয়ে বলছে, পাগলকে আর কী বুঝ দেব বাবা। তোর ছেলেকে খুঁজে এনে দেবার সাধ্যি পুলিশের বাবারও নেই। কে জানে কোন্ চুলোয় গেছে।
পাগল যখন তখন ক্ষেপে ওঠবার অধিকার তার আছে। সেই ক্ষ্যাপা গলায় লোকটা পরিত্রাহী গলায় চেঁচায়, মিচে কতা বলচ আপনি। আপনি জানো কোতায় তারে চালান করে দেচো।..পুলিশের বাপের সাদ্যি নাই? তার অসাদ্যি কিছু আচে না কি?..কাউর প্রিতি সন্দ হলি আপনারা সগগো মত্তে পাতাল ছুঁড়ে তারে খুঁজে বের করো না? শ্যালের গত্ত থেকে উটকে বের করতে পারো আপনারা, মায়ের গভ্যো থেকে হিঁচড়ে টেনে আনতি পারো, আর আপনাদের হ্যাঁফাজত থেকে একটা ছেলে কঞ্জুরের মতন উপে গেল। তার সন্ধান নিতি পার না? আলবাৎ পারতি হবে। ক্যানো? গরীব বলে মানুষ নয়? তার মা বাপের পেরাণ পেরাণ নয়? আজ আপনার ছেলেডারে যদি কেউ ধরে নে গিয়ে গুম করে রাকে, ক্যামন লাগে?
অ্যাঁ। অ্যাঁ! কী বললি? অকথ্য একটা সম্বোধন করে দারোগাবাবু চীৎকার করে ওঠেন। তুই আমায় ভয় দেখাচ্ছিস?…গণেশ! রঘু।..যা তো এটাকে নিয়ে গিয়ে রাম ধোলাইয়ের কলে ফেলগে যা।…শালা ঘুঘু দেখেছে ফাঁদ দেখেনি। যাঃ। পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে…তক্তা বানিয়ে