তা সেই দুর্মতির ওই ফল!
আধাজোয়ান লোকটাকে উদোম করে তার কাপড় দিয়ে তাকে দাওয়ার খুঁটির সঙ্গে বেঁধে… চামড়ার বেল্ট লোহার কাটার চাবুক, থানায় কিছুর অভাব আছে কি? হলেই বা ছোট থানা, জাত সাপের ছানা তো!
এক এক ঘা কোঁড়া খাচ্ছিল কুঞ্জ আর চীৎকার মারছিল, আমি উসব কতা বলি নাই। আমি উসব কতা বলি নাই, মিচে কতা। সব মিচে কতা।
কিন্তু কে শুনছে তার কথা?
তা সেই দৃশ্য দেখে যাবার পর আবারও আজ এসেছে লোকটা? প্রাণে ভয় ডর বলে কিছু নেই? ছোট দারোগা যা বলে তাই নয় তো?
ছোট দারোগা বলে পাগল। বদ্ধপাগল।
হল্লার মাত্রা বেশি বাড়ালেই দারোগা গণেশ আর রঘুকে হাঁক পেড়ে ডেকে বলে পাগলাটাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বনে জঙ্গলে শেয়াল কুকুরের মুখে ছেড়ে দিয়ে আয় দিকি। আর তো সয় না। আচ্ছা এক ফ্যাসাদে পড়া গেছে।
কিন্তু এইটুকু বলেই যদি ক্ষান্ত হত কত্তা, তা হলে যা করবার গণেশ আর রঘুতেই করে ফেলতে পারতো। শেয়াল কুকুর বাঘ ভালুক হাঙর কুমীর, যাই দরকার হোক মানুষ আর কোন্ ভূমিকাটা না নিতে পারে? পারলে কি হবে, ধরে নিয়ে যাবার হুকুমের সঙ্গে সঙ্গেই যে দারোগাবাবু আর এক হুকুম জারি করে বসে–মারধোর করিসনে বাপু, মারধোর করিসনে, পাগলছাগলদের শুনেছি বেটরে লেগে ফেগে গেলে রক্ত বমি হয়ে চড়ি ওলটায়।
কে জানে পুঁথিপড়া বিদ্যেয় বলে, না জ্ঞান গোচরের বিদ্যেয় বলে। যাই হোক, বলে তো? তারপর আর কী করবার থাকতে পারে গণেশদের?
গণেশ রাগে গরগর করতে করতে চুপি চুপি বলে, দারোগাবাবুটা ব্যাটাছেলে না মেয়েছেলে রে? আজকাল তো মেয়েছেলেয় সব হয়, জজ ম্যাজিস্টেট উকিল ব্যালিস্টের সব। আর পেন্টুলও পরে মেয়েছেলেরা। নিঘাত মেয়েছেলে, নচেৎ এত অপমান গায়ে বেঁধে না?
রঘু খি খি করে হেসে বলে, ঘরের মধ্যে তো জলজ্যান্ত একটা পরিবার বসানো আছে। তোর কপাল মন্দ তাই কত্তার আসল রূপটা দেখতে পেলিনে। এই বাণ খাওয়া মূত্তি দেকচিস।
কিন্তু আড়ালে যা বলুক সামনে তো আর অবাধ্য হতে পারে না? তাই নিসপিস করা হাত দুটোকে কোনমতে বশে এনে শুধু লোকটাকে দুজনে দুদিক থেকে ধরে হিচড়োতে হিচড়োতে নিয়ে চলে যায়।…দুটো দুটো চারটে হাত-পা দুজনে ভাগ করে নেয়, লোকটার ঘুসি লাথির আক্রমণ থেকে জান বাঁচাতে।
নিয়ে যায় চ্যাংদোলা করে।
থানার এলাকা ছাড়িয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসে কাটা বনে, শ্যাওলার পুকুরে। আর মুখটা চালিয়ে যায় সমানে। তাতে তো আর পাগলের রক্তবমির ভয় নেই। গণেশেরই যেন বেশি রাগ।
লোকটার ওপর কী গণেশের কোনও কারণ ঘটিত পূর্ব আক্রোশ আছে? তাই এত নিসপিস করে?
তা ঠিক নয়।
.
চাকরী জীবনে জীবনভোর যা দেখে অভ্যস্ত তার ব্যতিক্রম দেখে ছটফটানি ধরে গণেশের। ধোলাই খাবার এমন প্রকৃষ্ট কারণ থাকতেও লোকটা ভোলাই খাচ্ছে না, এটা কী সহ্য করার মত ব্যাপার?
হাতের সুখই যদি না করতে পেল, তবে আর পুলিশে কাজ করতে আসা কেন?
তবে গতকাল একটু যেন আশার আলো দেখতে পেয়েছে গণেশ, দারোগাবাবু কাল আচ্ছা করে শাসিয়েছে লোকটাকে। ফের যদি এসে হল্লা করে তো রেয়াৎ পাবে না। এমন কি কুঞ্জ ব্যাপারীর ধোলাইয়ের দৃশ্যটা দেখিয়ে, সমঝে দিয়েছে, এটা কিছুই নয়, আরও যা যা পদ্ধতি আছে শুনে রাখ। ভয়ঙ্কর বীভৎস সেই পদ্ধতিগুলো অবলীলায় শুনিয়ে দিয়েছিল দারোগাবাবু।
শুনতে শুনতে আহ্লাদে গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠেছিল গণেশের। আহা আছে এ সব ব্যবস্থা কেষ্টপুর থানায়? ..তবে এও ভেবেছিল সে রোমাঞ্চ অনুভব করবার সুখ আর গণেশের ভাগ্যে হবে না। এ সব শুনে কাল আর আসবে না লোকটা।
আশ্চর্য! আজও সেই একইভাবে এসে হাজির হয়েছে লোকটা।…কাল কোথায় ফেলে দিয়ে এসেছিল ওকে গণেশরা? ধান কেটে নেওয়া শুকনো ক্ষেতের মধ্যে না?
ছুরির আগার মত ধারালো খড়ের আগার ওপর।…
গণেশ আরব্ধ কাজ না সেরেই মুঠোয় চাপা নিমকাঠিটা দাঁতের ফাঁকে আটকে নিম পাতার রসে জারিত গলায় বলে ওঠে, আবার আজ এসেছিস শালা? পেরাণে ভয় নেই?
লোকটা হনহনিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, ঘুরে দাঁড়িয়ে লাল লাল চোখ দুটোয় আগুন ছিটকে বলে চোপরাও হারামজাদা শুয়োর! তুই বলবার কে? তোর কাঁচে এইচি আমি?
অ্যাঁ! কী বললি?
গণেশ প্রথমটা প্রায় হতচকিত হয়ে যায়।
অবিশ্বাস্য বিস্ময়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন বোকার মত তাকিয়ে থাকে লোকটার দিকে। চুলগুলো-নোংরা ধুলো মাখা চারটি পাটের মত, গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা কাঁচা পাকা দাড়ি, পরনে একটা বর্ণহীন লুঙ্গি, গায়ে একটা ফালি ফালি শার্ট। পুরো পাগলের চেহারা। আর জ্বলন্ত আগুনের ঢেলার লালচে ধ্বকধ্বকেচোখ দুটো যেন ওই চেহারার সমাপ্তি রেখা, শেষ তুলির টান।
তা যাই হোক, তবু আজ পর্যন্ত গণেশ চৌকীদারকে এভাবে অপমান করেনি কখনো।
গটগটিয়ে আসে, দারোগার বাসার সামনে গিয়ে হল্লা করে। যদিও চেঁচানিটা নৈর্ব্যক্তিক।
শালার পুলিশ! ছেলে খুঁজে এনে দিবিনে মানে? তোর বাবা দেবে। মাজ আত্তিরে ছেলেডারে বেছনা থেকে টেনে তুলে নে এসে হাপিস করে দিয়ে এখন মিচে করে বলছিস কিনা সে বেবাগী হয়ে গেছে। কেন? কিসের দুস্কে বেবাগী হতে যাবে দুদের বালক ছেলেডা? বল কোতায় গুম করে রেকেচিস তারে? কোতায় চালান করে দিচিস!
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই কটা কথাই বলে।