- বইয়ের নামঃ খুন
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
খুন
গণেশ চৌকীদার থানার ঠিক পিছনের রাস্তাটার ধারেই পাঁচ আইন ভঙ্গ করতে দাঁড়িয়ে পড়ে অবচেতনিক অভ্যাসেই এদিক ওদিক তাকাল, আর তখনি দেখতে পেল হতভাগাটাকে।
রোজকার মতই উগ্রচণ্ডা মূর্তিতে হনহনিয়ে আসছে। যেমন লক্ষ্মীছাড়া চেহারা, তেমনি লক্ষ্মীছাড়া কেশবেশ, সন্দেহ নেই বাসি মুখেই চলে এসেছে।…গণেশ চৌকীদারের হঠাৎ মনে হল নিশ্চয় লোকটার মাথায় উকুন আছে।
মাথায় উকুনওলা একটা হতভাগা লোক ঠিক এই সময়ই হঠাৎ উদয় হয়ে গণেশের শান্তি ভঙ্গ করবে, এটা অসহ্য বইকি। গণেশের ইচ্ছে হল পায়ের কাছে পড়ে থাকা পাথুরে ঢিলগুলো থেকে একটা কুড়িয়ে নিয়ে লোকটার দিকে ছুঁড়ে মারে। কিন্তু ইচ্ছেটা সামলে নিতে হল। একবার ওইরকম ঢিল ছুঁড়ে ভারী ফ্যাসাদে পড়তে হয়েছিল গণেশকে। পেয়ারা গাছে চড়ে হুটোপুটি করতে আসা ডাকাবুকো ছেলেটা যে সামান্য একটা ঢিল খেয়ে লটকে গাছ থেকে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়বে, এটা কে জানতো? পড়ল তো পড়ল একেবারে পটলই তুলল ছোঁড়া!
থানার ওসি সেই পেয়ারাতলা থেকে একখানা কোণ-ভাঙা থান ইট তুলে নিয়ে প্রশ্ন করেছিল, এটা গণেশের কাছে সামান্য কিনা।
গণেশ বেচারা মাটি হাতড়ে হাতড়ে অনেকগুলো মাটির ঢেলা তুলে তুলে দেখিয়েছিল, মা কালীর দিব্যি গেলেছিল, বদমাইস ওসিটা সে কথা মানতেই চায় নি। বলেছিল, তোমার ফাঁসি হওয়া উচিত।
তা ফাঁসি অবশ্য হয়নি গণেশের, তাই যদি হবে, তা হলে বটবৃক্ষের ছায়া কথাটার মানে কী? ছায়ায় আছে বলেই না? খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে থাকলে, চট করে কি থান ইট তুলতে সাহস আসে? সে যাক, ফাঁসি টাসির প্রশ্ন নয়, তবে ওই যুধিষ্ঠির ওসিটার হস্তক্ষেপে দুর্গতি ঘটেছে গণেশের। কালনার মত ভাল শহুরে সদরখানা থেকে বদলী হয়ে এই কেষ্টপুরে এসে পড়েছে।
থানা ছোট্ট হলেও, থানার কম্পাউন্ডটা মস্ত। জায়গা জমির তো অভাব নেই এখানে। এই কম্পাউন্ডের মধ্যেই ছোট দারোগার কোয়ার্টার্স, ছালওঠা ইটের বেঁটে একতলা, জানলা দরজায় আলকাতরার প্রলেপ। ও হদ্দ থেকে দূরে এ হদ্দে গণেশ আর রঘুর টিনের চালা। মাঝখানে রাস্তার ওপর তিনটে সিঁড়ি উঠে থানা। তার পিছনে হাজত ঘর।
অনুষ্ঠানের ত্রুটি নেই।
তবু গণেশের মন হুহু করে। যেন নির্বাসন দণ্ড হয়েছে তার।
আর সেই হুহু করা মনের ওপর রোজ এই জ্বালা।
হতভাগার না কি একমাত্তর ছেলেকে কোন একরাত্রে পুলিশ ধরে এনেছিল, নিগূঢ় কোনও সন্দেহে। তারপর মানে জিজ্ঞাসাবাদের পর না কি ছেড়েও দিয়েছিল, কিন্তু উনিশ-কুড়ি বছরের সেই ছেলেটা নাকি সেই রাত থেকেই নিখোঁজ।
নিখোঁজ তো নিখোঁজ, পুলিশে কী করবে? পুলিশ তার কর্তব্য করেছে বইতো নয়।
পেটের কথা আদায় করতে খানিক ধোলাই দিয়েছে, এছাড়া আর কোন পদ্ধতি জানা আছে পুলিশের? ছেলে যদি নিখোঁজ হয় পুলিশের কী দোষ? কিন্তু লক্ষ্মীছাড়া হতভাগাটার দাবি কী? না, পুলিশ যখন মাঝ রাত্তিরে ঘর থেকে ছেলে তুলে এনে আটক করেছিল, তখন নিখোঁজ ছেলেকে খুঁজে বার করে এনে দেওয়া পুলিশেরই ‘কোর্তব্য’।
যেন কোর্তব্য করতেই পুলিসের জন্ম।
যেন মানব সেবা করতেই তাদের আবির্ভাব। মাটির মানুষ ছোট দারোগা কি কম বুঝ দেয় লোকটাকে? গণেশের তো দেখেশুনে অবাক লাগে। অন্য কেউ হলে কবেই জন্মের শোধ হতভাগার ঘ্যানঘ্যানানি ঘুচিয়ে দিতো।…
কিন্তু ছোট দারোগা কেবল বুঝ দেয়, আচ্ছা তোর ছেলে যদি নিজেই বেবাগী হয়ে যায়, পুলিশের কী দোষ? দু ঘা চড় চাপড় দিয়ে সেই রাতেই তো বাবা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। এখন তাকে কোথায় পাবো?
কিন্তু পাজীটা মানবে না সে কথা।
রোজ রাত না পোহাতেই বাসি মুখে হনহনিয়ে চলে আসবে, আর একঘেয়ে শ্লোগান দিয়ে চলবে, মাজ আত্তিরে বেছনা থেকে টেনে তুলে নে এসে ছেলডারে হাপিস করে দিলি তোরা আর খুঁজে দিবিনে?
প্রত্যেক দিন এই এক হল্লা। কটুকুৎসিত বিরক্তিকর।
গণেশ মাঝে মাঝে অবাক হয়ে রঘুকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা মাটির মানুষ হলেও সত্যি তো আর মাটি বালি নয়। এতো সহ্যি করে কী করে দারোগাবাবু?
ভগবান জানে। কথায় দারিদ্দির রঘু। সব প্রশ্নের উত্তরের দায়িত্ব ভগবানের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে চুপ মেরে থাকে। শুধু একদিনই বলে ফেলেছিল, দারোগারও দারোগা থাকে রে গণশা। সেই ভয়েই কর্তা মাটি বালি হয়ে বসে আছে। নইলে ছ মাস আগে যদি আসতিস, দেখতিস কত্তার মূত্তিখানা।
ব্যস আর নয়, ওই পর্যন্তই।
ওই ঊর্ধ্বতন দারোগাটি যে কে সে রহস্য আজও গণেশের কাছে দুর্ভেদ্য হয়ে আছে।
কিন্তু ধৈর্যের একটা সীমা আছে। মাটিও সময়ান্তর ফেটে চৌচির হয়।
গতকাল ছোট দারোগা সেই ফাটা ফেটেছিল। আর ওই লক্ষ্মীছাড়া হতভাগা শেয়ালমুখো দাঁড়কাকটাকে জম্পেস একটি টাইট দিয়ে বলেছিল, ফের যদি ঘ্যানঘ্যানাতে আসিস, রাম ধোলাই খেতে হবে তা বলে দিচ্ছি।
পুলিশের রাম ধোলাই যে কী বস্তু তাও সমঝে দেওয়া হয়েছিল লোকটাকে, হাজত ঘরের পিছনের উঠোনে নিয়ে গিয়ে।…সেখানে তখন ভোলাই চলছিল, বেস্পতির হাটের কুঞ্জ ব্যাপারীর ওপর।
দুর্বুদ্ধি কুঞ্জ পুলিশের পেয়াদাকে হাটের সওদা থেকে ইচ্ছে মত তোলা তুলে নিতে তো দেয়ই নি, তার ওপর আবার মুখ করেছিল। না কি আসপদ্দার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে রঘুর হাত থেকে জিনিস কেড়ে নিয়ে বলেছিল, যা যা ভাগ। বলে দিগে যা তোর পুলিশ বাবাকে, দেখব সে আমার কী করে। মন্ত্রীদের রাজ্যে বাস করছি বইতো মগের মুলুকে বাস করছি নে।