বলল, সংসার চালাতে অবশ্য প্রয়োজনীয় হিসেবে অনেকগুলো পাতানো বোনপো পুষতে হয়?
আরও শুকনো গলায় বলে খুকু, অনেকগুলো আবার কী?
ওই হল আর কী! গৌরবার্থে বহুবচন।
খুকু কান পাতে নিবিষ্ট হয়ে। ওঘরের কলধ্বনি আবার স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কী বললে? পাতানো বোনপো পুষতে হয়। বাড়িতে তাদের আসতে দেওয়া হয়?
তা বাড়িতে আসতে না দিলে, তারা কি রাস্তা থেকে আমার উপকার করে যাবে নাকি? আসতে দিতে হয়, বসতে দিতে হয়, চা খাওয়াতে হয়,
হয়! এত সব হয়! কর্তা প্রবল গর্জনে প্রতিবাদ করে ওঠেন, বলি এত সব হওয়ার বদলে কী কী মহৎ উপকারটা হয় শুনতে পাই?
সীমা বেশ ডাঁটের সঙ্গে বলে, অনেক কিছুই হয়। তোমার ছেলের দ্বারা তো এক ইঞ্চি কাজও হয় না। সিনেমার টিকিট কিনতে পাঠালাম টাকা দিয়ে, ফিরে এল ছেলে, বলল, হল না, হাউস ফুল। অথচ আমার সোনার চাঁদ পাতানো বোনপো তক্ষুনি সেই টিকিটই এনে দিল।
দিল! বলি কোথা থেকে দিল শুনি?
এলেম থাকলে সবই হয়।..এই তো ত্রিভুবনের কেউ যখন দালদা পাচ্ছে না, স্বপন আমায় দু-দুটো দুকিলো দালদার টিন এনে দিল–
কর্তা হিংস্র গলায় বলেন, যখন ওই দালদার টিনের বদলে মেয়ে খোওয়া যাবে, তখন বুঝবে ঠ্যালা!
মেয়ে খোওয়া যাবে? গেলেই হল?
না যাবে না! পৃথিবী দেখছ না? আমি এই বলে দিচ্ছি, তোমার ওই আদুরে খুকুকে যদি সামনের মাসেই না পাত্রস্থ করি।
সীমা ব্যঙ্গের গলায় বলে, পাত্র মজুত আছে বুঝি?
অভাবও নেই। ডজনে ডজনে প্রজাপতি অফিস আছে—
খুকু আর্তনাদের গলায় বলে, দাদা!
পিন্টু নির্লিপ্ত নিরাসক্ত গলায় বলে, কাতর আর্তনাদে কোনও ফল নেই, এলেম থাকে বাবাকে গিয়ে জোর গলায় বলগে যা, বাবা, মেয়ের বিয়ের জন্যে সোনাদানা,.টাকাকড়ি, ঘড়ি, আংটি, বোতাম-ফোতাম, জামাকাপড়, বিছানাবালিশ, খাট-আলমারি, সোফা-সেটি ইত্যাদি প্রভৃতি আলটু-বালটু মালগুলো তুমি যোগাড় কর, আসল মালটি তোমায় আর কষ্ট করে যোগাড় করতে হবে না, ওটা আমি ম্যানেজ করব
আঃ দাদা! ওই কথা বলব আমি বাবাকে?
না বলতে পারলে, হল না। তবে হওয়া আর না-হওয়া! শেষ পর্যন্ত তো প্রেমালাপের নমুনা ওই–যা শুনতে পাচ্ছ–
ধ্যেৎ! সবাই যেন
সবাই। সবাই। সংসার-চক্রে তেলের ঘাটতি হলেই কাঁচ-কেঁচ শব্দ ওঠে। তাছাড়াও আরও বহুবিধ জটিল ব্যাপার আছে।…
মা-বাবার বিয়েটাও তো শুনেছি পছন্দ করে বিয়ে!
আহা রে! কে বলেছে তোকে? বলল খুকু।
শুনেছি বাবা শুনেছি! বড়মাসির শ্বশুরবাড়ির কোনও বিয়েবাড়িতে মাকে দেখে বাবা—
ওঃ! সেই!
খুকু গৌরবান্বিত গলায় বলে, সে কথা ছেড়ে দাও। ভেবে আশ্চর্য হয়ে যাই, কিসের ওপর ওঁরা জীবন চালিয়ে আসছেন!
খুকুর বলার ভঙ্গিতে এইটাই প্রকাশ পায়, আমাদের স্বর্গীয় প্রেমের সঙ্গে ওনাদের কিছুর তুলনাই হয় না!
কিন্তু ওদিকে যে এখনও যুদ্ধ-সমাপ্তির চিহ্নমাত্র নেই।
যুদ্ধনিনাদ মাঝে মাঝে অস্পষ্ট, মাঝে মাঝে স্পষ্ট। তার মানে ওঁরা লম্বা দালানটায় পায়চারি করে করে তূণ থেকে বাণ নিক্ষেপ করছেন।
সহসা কর্তার শব্দ প্রবল স্পষ্ট, আলবাৎ বলব! মেয়ে আমার!
মেয়ে তোমার? সীমার স্বর স্পষ্ট হলেও রুদ্ধ, তোমার একলার? মেয়ে নিয়ে যা কিছু কষ্ট খাটুনি ভোগান্তি সব আমার, আর অধিকারের বেলায় তোমার?
এই সেরেছে! মা যে ফ্যাসাস শুরু করে দিল রে খুকু!
দিয়েছে? খুকু উল্লসিত গলায় বলে, তাহলে অবস্থা আয়ত্তে এসে গেছে!
পিন্টু ভীত গলায় বলে, না না, কী সর্বনাশ! এ সব কী বলছে মা? এই খুকু–
এখন
সীমার অশ্রুবিজড়িত কণ্ঠধ্বনি শোনা যাচ্ছে, জীবনভোর শুধু এ সংসারের চাকরানীগিরিই করে এলাম। একদিনের জন্যে কারুর কাছে একটু মায়া পেলাম না, মমতা পেলাম না, আহা পেলাম না–এখনও এই। আর আমার সংসারে সাধ নেই, এই তিন সত্যি করছি–মরব, মরব, মরব। হয় বিষ খেয়ে, নয় গলায় দড়ি দিয়ে
খুকু!
খুকু আত্মস্থ গলায় বলে, কিচ্ছু ভয় পাস নে, আর চিন্তা নেই, তরঙ্গিত সমুদ্র থেকে তরণী এখন তীরে এসে লেগেছে। দেখ, কর্তার কণ্ঠে এখন আর হুঙ্কার শুনবি না।
তা খুকুর কথাটা মিথ্যা নয়, কর্তার কণ্ঠস্বরে আপোসের সুর।
ঠিক আছে! মরা কারুর একচেটে ব্যবসা নয়। অগাধ রেল লাইন পড়ে আছে গলা দিতে, পাহারা নেই কোথাও। আমার মতন হতভাগা, চোদ্দ ঘণ্টা পরে বাড়ি ফিরে যার কপালে এক কাপ চাও জোটে না, তার পক্ষে ওই পরিণতিই উচিত।
ইস! পিন্টু বলে, খুকু, তুই কী রে। মা না হয় ঝগড়া করছে, তোর তো উচিত ছিল বাবাকে একটু চা করে দেওয়া!
খুকু বলে, ক্ষেপেছিস! মা যেখানে ইচ্ছে করে উচিত কর্তব্যে অবহেলা করছে, সেখানে মাথা গলিয়ে আমি যাব উচিত কর্তব্য করতে? এই অধম খুকু বোকা হতে পারে, কিন্তু বুদ্ধ নয়। তাছাড়া ওই শোন্ না, চামচের টুংটাং শুরু হয়ে গিয়েছে।
পিন্টু সেই টুংটাং ধ্বনি একটুক্ষণ কান পেতে শুনে উদাস-উদাস গলায় বলে, আচ্ছা খুকু, আমি বাড়ি এসে চা খেয়েছি?
ওমা! কখন আবার খেলি? এসে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই তো লেগে গেল নারদ-নারদ!
হুঁ! কিন্তু দেখ, ইচ্ছে করলে মা তো আমাকেও এক কাপ অফার করতে পারত!
এই ঝড় বৃষ্টি বজ্রপাতের মধ্যে কি আর স্নেহ-দীপখানি জ্বলছে রে দাদা! চিরকালের কথা–রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখড়ের প্রাণ যায়!…আমরা, মানে ছেলেমেয়েরা হচ্ছে উলুখড়, বুঝলি? গৃহযুদ্ধের প্রধান বলি!