বিশ্বাস করবে না? বিশ্বাস করবে না? কর্তা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলেন, বিশ্বাস না করলে তো বয়েই গেল। আঁ! বলে কিনা বিশ্বাস করব না!..গামছা নিংড়োনোর মত শরীরের রক্ত নিংড়ে নিংড়ে শালার অফিস যাওয়া-আসা! বুকে পিঠে ভিড়ের চাপে দমবন্ধ হয়ে হয়ে হার্টের রোগ জন্মে গেল, রড় ধরে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শালার হাতে বাত, পায়ে গোদ হবার যোগাড়, আর বলে কিনা বিশ্বাস করি না!..মুরাদ থাকে তো একদিন গিয়ে দেখে এসো না? ঘরের মধ্যে আরামে আয়েসে বসে দুটো ভাতসেদ্ধ করতেই তো ক্ষয়ে যাচ্ছো! বুঝতে ঠ্যালা, যদি আমার মতন
এই অপমানের পরও কি সীমা চুপ করে থাকবে?
প্রিয়তম স্বামীর দুর্দশার বিবরণে ঈষৎ নরম হয়ে আসা মন আবার ফোঁস করে ওঠে।
কি, কী বললে? তোমার সংসারে ঘরের মধ্যে বসে আরামে আয়েসে শুধু দুটো ভাতসেদ্ধ করেই আমার কর্তব্য মিটে যায়? বলি তোমার সংসারের জুতো সেলাই চণ্ডীপাঠ চালাচ্ছে কে? মেয়ে তো আহ্লাদী ফুলকুমারী, দুপেয়ালা চা করতে হলে পাখার তলায় বসে হাঁপান। আর ছেলে? তিনি সারাদিন এমন রাজকার্য করে বেড়ান যে, একদিনের জন্যে গমটা ভাঙিয়ে আনতে পারেন না, রেশনে লাইন দিতে পারেন না।
অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না, চলছে শব্দভেদী বাণ ছোঁড়াছুঁড়ি।
পিন্টু বোনের ঘাড়ে একটা চিমটি কেটে চাপা গলায় বলে, এই খুকু, বাতাস ঘুরে যাচ্ছে, আক্রমণ আমাদের দিকে আসছে, সরে পড়ি আয়।
চলে আসে নিজেদের পড়ার ঘরে, বাতিটা খোঁজাখুঁজি করে, অবশেষে পায়, জ্বালে।…ওদিকে চলছে বাকযুদ্ধ, কান দেয় না।
পকেট থেকে একটা পাট-করা কাগজ বার করে পিন্টু অবহেলার গলায় বলে, এই নে। লণ্ড্রীর রসিদটা–
খুকু ভুরু কুঁচকে বলে, কার কি কাঁচতে গিয়েছিলে? খুলে দেখ
খুকু খুলে
ধরে কাগজটা মোমবাতির সামনে। পরক্ষণেই চাপা গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, দাদা! এর মানে? লণ্ড্রীর রসিদ?
পিন্টু পরম অগ্ৰাহে বলে, তা তোর লাভারের চিঠি, লণ্ড্রীর রসিদের থেকে আর কত উঁচুদরের?।
ভালো হবে না বলছি দাদা! যত সব অসভ্য কথা
পিন্টু ব্যঙ্গের গলায় বলে, আছো বেশ! তুমি লাভার জুটিয়ে লাভ করতে পারো, লাভলেটার চালাচালি করতে পারো, আর সেটা বললেই দোষ?
আহা! তাই বলে বুদ্ধ হাঁদাগঙ্গা ছোটলোকটা তোমার হাতে চিঠি দেবে?
আহা, ও কি আর নিজে সাহস করে দিতে আসছিল? লাইব্রেরীতে দেখা, অবোধ ইনোসেন্ট মুখে বলতে লাগল, পিন্টুদা, বাড়ির খবর কি? মেসোমশাই কেমন আছেন? মাসিমা কেমন আছেন? মাসিমার ঝি-টি ঠিকমত আসছে তো? রেশনে চিনি পেয়েছেন? কয়লা পাওয়া যাচ্ছে? এই সব। তখন বললাম, এত কথা তো তোমার মাসিমাকে জিজ্ঞেস করতে আমার মনে থাকবে না ভাই, তুমি বরং তোমার মাসিমাকে কি খুকুকে দুলাইন লিখে জিজ্ঞেস করে নাও
খুকু তেমনি চাপা গলায় ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, আঃ দাদা! তুমি না! এমন! উঃ!
হঠাৎ ওদিক থেকে একটা বাসন আছড়ানোর শব্দ এ ঘরে এসে আছড়ে পড়ল।
চমকে উঠল দুজনেই।
খুকু চমকে বলে, কী হল?
পিন্টু অম্লান গলায় বলে, কিছু না, কর্তা-গিন্নীর প্রেমালাপ বোধ হয় চরমে উঠছে।
তা কথাটা মিথ্যে নয়।
কর্তার প্রবল কণ্ঠের বাণী শোনা যায়, সংসার চালানোর বড়াই হচ্ছে। পায়ের কাছে বাসন ছড়ানো। অন্ধকারে লোকে হোঁচট খেয়ে মরুক।…এই সংসার চালানোর আবার বাহাদুরি। যাক, চুলোয় যাক! এ সংসারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে চলে যাব।
সীমা ওই পায়ের কাছে বাসন রাখার লজ্জায় যাও বা একটু নরম হতে যাচ্ছিল, তখনই সীমার প্রতি তীরটি নিক্ষিপ্ত হয়।
বটে! সীমা বলে ওঠে, তুমি চলে যাবে সংসারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে? আর আমি? আমি বুঝি বসে বসে সে আগুনে জল ঢালব? মনে জেনো আমি তার আগেই চলে যাব। বাপের বাড়ি একটা আছে এখনও, বুড়ো বাবা-মা কত বলে, একদিন আয়, কতদিন দেখিনি, এই তোমার সংসারের জন্যে একটা দিন গিয়ে থাকতে পারি না। আর আমায় বলা কিনা আরাম আয়েসের ওপর আছি!…বলি অফিসে তো আর সারাক্ষণই ফাইল ঠেলছো না, আড্ডাও তো চলে; বন্ধুরা বলে না এযুগে সংসার করার সুখটা কত!
একটু থেমে, একটু হাঁপিয়ে, একটু কেসে আবার শুরু করে, রাতদিন বাজার থেকে মাল উধাও হয়ে যাচ্ছে। আজ তেল উধাও, কাল দালদা উধাও, পরশু কেরোসিন উধাও, তরসু রেশনের গম চাল চিনি উধাও, নিত্যি দুধের গাড়ি আসছে না,–খালি বোতল নিয়ে ফিরছে, দশ-বিশ ঘণ্টা লোড়শেডিং, পাম্প চলে না, হিটার জ্বলে না, আটা ভাঙানোর চাকী বন্ধ, ফ্রিজের দফা গয়া, কে মনেজ করছে এসব? আগে সক্কাল বেলায় উঠে বাজারটা নিয়ম করে করে দিতে, এখন তাও তোমার নিত্যিই সময় হয় না, খবরের কাগজ পড়া আর দাড়ি কামানো এই করতেই সকাল কারার। ভাতটি খেয়েই লম্বা দাও, আর এই এখন এসে পদার্পণ! সারাদিনে কত মল্লযুদ্ধ চলছে জানতে পারো, না জানতে চাও? মনে করো সংসারের চাকাখানি আপনি চলছে মিহি মোলায়েম সুরে!..সেই চাকার তেলটি যোগাড় করতে যে ঝিয়ের পায়ে কত তেল দিতে হয় তার খোঁজ রাখো? কতগুলো পাতানো বোনো পুষতে হয় তার হিসেব রাখো?
ওরে বাবা, এই রাজধানী এক্সপ্রেস যে থামেই না দেখছি, পিন্টু বলে, দুশো মাইলের মধ্যে স্টেশন নেই!
খুকু এই কৌতুক উক্তিতে কান দেয় না, শুকনো গলায় বলে, মা ওই পাতানো বোনপোদের কথা কী বলল রে দাদা!