পিন্টু বলে, কথাটা মিথ্যে বলিস নি। ওরা তো মারতে উঠছিল। তাও চলে এলাম। কাল ফাদার যা ফায়ার হয়ে উঠেছিল। উঃ বাপ!
সীমা বলে, তবু ভালো! ফাদার ফায়ার হলে একটু ভয় আছে এখনও। মা রেগে মরে গেলেও তো
পিন্টু উদাত্ত গলায় বলে, মা? মার রাগে কি আর ভয় হয় গো? কথায় বলে মাতৃস্নেহ। কুপুত্র যদ্যপি হয়–
থাম্ থাম্ হয়েছে। তোকে আর শান্তর আওড়াতে হবে না। পকেট থেকে কী পড়ে গিয়েছিল পেয়েছিস?
হুঁ।
কী ওটা? চিঠি? চিঠির মতন মনে হল যেন?
ক্ষেপেছে! এ অভাগাকে চিঠি কে দেবে মা? এ একটা লণ্ড্রীর বিল।
লণ্ডীর বিল?
হ্যাঁ তো! অবাক হবার কি আছে? কুল্লে একটা টেরিট প্যান্ট আর একটা টেরিলিন শার্ট আছে বলে কি আর জন্মে, জীবনেও লণ্ড্রীর দরকার হয় না গো জননী!…তা বাড়িটা এমন আইসব্যাগ আইসব্যাগ লাগছে কেন বল তো? ফাদার কি খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন?
সীমা কিছু বলার আগে খুকু তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, না রে দাদা, বাবা এখনও আসেই নি!
তাই নাকি? পিন্টু কিছুটা অবাক গলায় বলে, গুড় বয়ের আজ এ কী অধঃপতন!
দাদা থাম্। মা দারুণ দুশ্চিন্তা করছে।
মা দারুণ দুশ্চিন্তা করছে? তা সেটা তো কিছু নতুন খবর নয় ভগিনী। দুশ্চিন্তা করাটাই তো মার পেশা। কারুর বাড়ি ফিরতে একটু দেরি দেখলেই তো মা ধরে নেয়, সে খট করে ট্রামে কাটা পড়েছে, সাঁ করে ডবল ডেকারের তলায় চলে গিয়ে ব্যাংচ্যাপ্টা হয়ে গেছে, নয়তো দুরন্ত লরির মুখে পড়ে স্রেফ ছাতু বনে গেছে।…তাই ভাবো না মা?
জানি না যা। আমি কোথায় ভাবছি তুই এসে পড়েছিস, কোনখান থেকে একটু খবরটবর নেবার চেষ্টা করবি, তা নয় তুই ইয়ার্কি মারতে বসলি!
খবর? কোনখান থেকে? এই নিবিড় আঁধারে! বুঝেছি, ব্যাপার বুঝেছি। বাবা নিশ্চয় সেই বিরাট প্রসেশানটার মুখে পড়েছে। দেখে এলাম কিনা খানিক আগে, মাইল দেড়েক লম্বা শোভাযাত্রা। শত শত যানবাহন আটকে আছে। সেটা-সেটা দেখেছি তা প্রায়, হ্যাঁ নটা। তার মানে আসতে এখনও খানিক দেরি আছে।
সীমা গম্ভীর গলায় বলে, সেই ভেবেই নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকতে হবে তাহলে?
ভেবে-টেবে নয়, আমি বলছি ওটাই ঠিক। নচেৎ এত দেরি হবার কারণ নেই। ওভারটাইম খাটলেও নয়।
সীমা স্থির কঠিন গলায় বলে, আর কিছু হতে পারে না?
পিন্টু তরল গলায় বলে, হতে অবশ্য কত কী পারে! বহু কষ্টে বহু আরাধনায় যে বাসটায় চেপে বসেছিল, সেই বাসটা ব্রেক ডাউন হয়ে যেতে পারে, মস্তান দাদুরা হঠাৎ আঙুল তুলে স্টপ বলে বাসটাকে অহল্যা পাষাণী করে দিতে পারে, আরোহীর সঙ্গে কনডাকটরের বিরোধ ঘটায় গাড়ি চলা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এটা তো কখনই হবে না, বাবা এই বৃদ্ধ বয়েসে কোনও বান্ধবী যোগাড় করে ফেলে, সেখানেই চা খাচ্ছে মাছের চপ খাচ্ছে ডিম ভাজা খাচ্ছে আড্ডা দিচ্ছে–
সীমা কঠোর কঠিন গলায় বলে, খুকু, টর্চটা আমায় দাও, আমি এগারো নম্বরের হরনাথবাবুর বাড়িতে যাই একবার–
এগারো নম্বরের হরনাথ বাবুর বাড়ি?
পিন্টু অবাক হয়ে বলে, এই রাত দশটার পর? কী বলবে গিয়ে?
কী আর বলবো? বলবো–বলবো
কথা শেষ হল না, আবার দরজায় ধাক্কা পড়ল। প্রবল ভাবে। যেন দরজা ভেঙে ফেলবে।
সীমা স্খলিত স্বরে বলে ওঠে, বুঝেছি! সর্বনাশ হয়ে গেছে, পুলিসের লোক খবর দিতে এসেছে! পিন্টু
পুলিস! এই সেরেছে! দাদা তুই যা–
যাচ্ছি। মা টর্চটা দাও—
পিন্টু দরজা খুলে দেয়, এবং সঙ্গে সঙ্গে গৃহকর্তার হুঙ্কার শোনা যায়, কী ব্যাপার কী? ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি সবাই মিলে?
এই লোকটার জন্যে এতক্ষণ এত দুশ্চিন্তা করছিল সীমা! প্রাণের মধ্যে এত উথাল-পাতাল হচ্ছিল।
অবিরত চোখের সামনে অজানা অচেনা কোন এক রাস্তার মাঝখানে লোকটার ছিন্নবিচ্ছিন্ন রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকতে দেখতে পাচ্ছিল, দেখতে পাচ্ছিল পুলিস, অ্যাম্বুলেন্স, ডাক্তার, নার্স, হাসপাতালের খাট, মাথায় ব্যান্ডেজ, (সিনেমার কল্যাণে যে সব দৃশ্য দেখে দেখে মুখস্থ), নাকে অক্সিজেনের নল, মর্গ, খাঁটিয়া, সাদা চাদর মোড়া শরীর, অগুরু চন্দন, ফুলের মালা, চিতার আগুন, থান, হবিষ্যি, শ্রাদ্ধসভা, মুণ্ডিতমস্তক পুত্র–
এইখানটাতেই একটু ঠেক খাচ্ছিল সীমা, ওই নাস্তিক মস্তান ছেলে কি আর তার সাধের ঘাড় ছাড়ানো কেশকলাপ মুড়োবে?
এসব চিন্তা তো ইচ্ছাকৃতও নয়, চেষ্টাকৃতও নয়, চোখের সামনে এসে যাচ্ছিল, ভেসে যাচ্ছিল, নাচানাচি করছিল। নেচে নেচে সীমা নামের একটি প্রেমের প্রতিমাকে কাবু করে দিচ্ছিল, শিথিল করে দিচ্ছিল তার হাত-পা, সেই শিথিল স্নায়ুর উপর পড়ল এই হাতুড়ির ঘা।
এ ঘাড়ে সীমা যদি ছিটকে ওঠে, দোষ দেওয়া যায় না তাকে।
ছিটকে-ওঠা সীমা তীব্র তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, ঘুমোবে কেন? বাড়ির গিন্নী মরে পড়েছিল, তাই ছেলেমেয়েরা পাথর হয়ে বসেছিল। বলি বলতে একটু লজ্জা করল না? রাতদুপুরে বাড়ি ফিরে
ক্রুব্ধ গৃহকর্তা আরও গলা চড়ান, লজ্জা করবে? কেন? কেন? লজ্জা করবে কেন শুনি? এতক্ষণ কি আমি তাড়িখানায় বসে তাড়ি খাচ্ছিলাম? না বন্ধুর বৌয়ের হাতের পান খাচ্ছিলাম?
সীমার স্বর তিক্ত তীক্ষ্ণ, কী করছিলে তা নিজেই জানো। এ কথা তো বিশ্বাস করব না ড্যালহাউসী থেকে রাসবিহারীতে আসতে তোমার পাঁচ ঘণ্টা সময় লেগেছে