ইমুন কথা কইসনা পরী, আমার বুক ভাইঙা যাইব গা। গলায় বেষ্টন করার পর ওর ঘাড়ের কাছে কাইতনের প্রান্ত দুটোতে গেরো দিয়ে বলল, কয়দিন আর আছি, শেষমেষ আমারে একটু শান্তি দিয়া যা তুই পরী।
লোমশ বুকটাতে মুখ লুকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, ক্যামনে আপনেরে শান্তি দিয়াম আমি? আমার তো কিছুই করার নাই। আমার সোয়ামি আছে যে!
পরিচিত কায়দায় তৈরি হতে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে মোল্লা বলল, নাই নাই হে আর নাই। তরে মারছে, হেরে আমি গলা টিইপ্যা মাইরা আছি। কেউটে সাপের ছোবল খাওয়ার মতো পরী আর্তনাদ করে উঠতে চাইলে ওর মুখটা চেপে ধরে মোগ্লা। ও আঙুলের ফাঁকে চ্যাপটা হয়ে থাকা মুখে জিগগেশ করল, সইত্য কইছেন?
সইত্য না মিথ্যা? রইম্যারে খতম কইরা আইছি, দুনিয়া উলিডা যাউগ গা আমি তরে শাদি করুম পরী।
পরীর বুকের ভেত্রটা লোমে-ঢাকা মুর্গির সিনার মতো দুরুদুরু করে কাঁপছিল, বলছে কি লোকটা? মাথা খারাপ হয়ে গেল। ওর মোটেই বিশ্বাস হচ্ছে না। এতবড় তাগড়া জোয়ান লোকটাকে বুড়ো শেষ করে দিতে পেরেছে? সে তার হাতটা টেনে নেয়, কাঁধের গোড়া থেকে ধরে আস্তে আস্তে নিচে নামিয়ে আনে, চামড়া আলগা ধরনের বটে কিন্তু হাতটা সত্যিই বেশ কঠিন, হাড্ডি বেজায় মোটা। এরপর রে ছোট্ট হাতটা দিয়ে তার হাতের পাঁচ আঙুল, কজি ও তালু ধরে ধরে দেখে, সেগুলোও বেশ শক্ত আর চওড়া। হঠাৎ সে ফুঁপিয়ে উঠে দুই চোখের পানি ছেড়ে দিল, নানা!
তুই কান্দিস না পরী আমি তরে নিহা করুম, আমার অনেক ট্যাহাপয়সা জমি জমা আছে র কোনো কষ্ট অইব না। কেডা কি কইব, আমিই তো গ্রামের মাতব্বর। এই নে ধর।
মোল্লা আরেকটা পুটলি ওর হাতে গুঁজে দিল। বেশ বড় আর ভারী। কাঁচা টাকা আর রেজগিতে ভরা। পরী সেটা ধরল না। তখন মোল্লা পোটলাটা ওর কাপড়ের খুঁটে বেঁধে তাকে শুইয়ে দিল কাঁথার ওপর। অনেকক্ষণ কেটে গেল। দ্রুত ধুকধুক করতে করতে ধনু মোন্নার হৃৎপিণ্ডটা বিকল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। ঘন ঘন হাঁপাচ্ছে, মুখের দুই কষে ফেনা দেখা দিয়েছে। পরী উঠে পড়তে চাইলে ওকে ঠেলা দিয়ে ফেলে বলল, আরেকটু থাক্ পরী, আরেকটু!
কিন্তু সব বৃথা। চরম বিরক্তির সঙ্গে ঝামটা মেরে উঠে দাঁড়িয়ে ও ঠিকঠাক হতে থাকে। নিঝঝুমি রাত্রি; কিন্তু অকস্মাৎ চারিদিকটা যেন অট্টহাস্যে মুখরিত হয়ে গেল। দুই হাতে মুখ ঢেকে মাটি লেপটে বসে পড়ে ধনু মোল্লা। বিফল, বিফল সব উদ্যম ধ্ব আয়োজন বিফল। এখন নিজের বিরুদ্ধেই যত আক্রোশ পারলে নিজেকে আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে, ন্যাকড়ার মতো ঝুলে পড়া দেহটাকে করে ছিন্নভিন্ন।
তাকে ছাড়িয়ে দরজার দিকে যাওয়ার সময় কাপড়ের বাড়ি লাগল গায়ে, মোন্না আঁতকে উঠল, পরী, পরী, তুই যাইস না পরী! আরেকবার দ্যাখ আমি পারুম্।
গলার স্বরটা কান্নার মতো; কিন্তু তবুও ফিরেও চাইলো না, দুধুপ করে বাইরে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় একান্ত অস্পষ্টস্বরে বলল, বুইড়া।
অন্ধকারে আরো কিছুক্ষণ বসে থাকে ধনু মোল্লা। পথের ধারে ধূলিবালির মধ্যে বসে-থাকা ভিখিরির চেয়েও দীন-হীন রিক্ত নিঃস্ব যেন। হঠাৎ মনে পড়ল, টাকার পোঁটলাটা নিয়ে থাকে নিক, কিন্তু মাদুলি ছড়াটা তো দিয়ে যায়নি? রাত আছে, এখনি সময়। পরে আদায় করা মুশকিল হতে পারে। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিঃশব্দে হাঁটতে থাকে। আসমানে অনেক তারা জ্বলজ্বল করছে। বাঁশঝাড়ের পাতায় ঝিরঝিরে বাতাসের মৃদু নড়াচড়া। বিহান হয়ে এল নাকি? বাঁশের তৈরি আওতার মধ্যে দরজার মতো ফাঁকটা দিয়ে ওধারে গেলেই একটু দূরে রমুর ছনের ডেরাটা, খরের বেড়া, অনেক জায়গায় ফাঁক-ফোকর। পায়ের শুকনো পাতা মচমচ্ করলে চমকে ওঠে। হকচকিয়ে ফিরে তাকায় এদিক-ওদিক। রমু নাম করা চোর, ওর কাজই রাত্রে বেলায়। হঠাৎ এসে পড়াটা বিচিত্র নয়। পরীকে ভয় পাইয়ে বশ করবার জন্য খুনের বানানো গল্পটায় কাজ হয়েছিল বেশ।
সাবধানে বেড়ার কাছে যাওয়ার পর একটু ঝুঁকে কান পেতে থাকে। অবস্থাটা আঁচ না করে পরীকে ডাকা ঠিক হবে না। এ-সময়ে চোর ব্যাটা তো ঘরেও থাকতে পারে। ভিতরে নড়াচড়ার আওয়াজ হচ্ছে।
হঠাৎ খচখচ করে দেশলাই কাঠি জ্বলে উঠলে বেড়ার একটা ফাঁকে চোখ রাখে ধনু মোল্লা, সব দেখা যাচ্ছে; তেল-চিটচিটে বালিসে মাথা রেখে হোগলার ওপরলম্বা হয়ে শুয়ে আছে রমু, শিয়রে মাটির বার ওপরে রাখা কুপির মুখে আগুন দিল পরী। সে এখন ধীর, স্থির। আলোর দিকে চাইতে ওর গলায় মাদুলি ছড়াটা ঝিকমিকি করে উঠলো। নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে লোকটা, কোনো তাড়া নেই। ডান হাত পিছনে নিয়ে আঙুলে ধরে ঘুরিয়ে আনে কাইতনের গোড়াটা, তারপর দুইহাতে খুঁটে খুলতে থাকে। ছড়াটা খুলে ডানহাতের তালুতে নিল, অসম্ভব বস্তু, এমন জিনিস পাবে, কোনদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। বিয়ের সময় পেয়েছিল শুধু কয়গাছি রূপোর চুড়ি, আর একটি রূপোর চেইন। সেগুলোও কবে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। এখন গলা খালি, আর হাতে পরে বাঙড়ি; কিন্তু সেও সবসময় নয়, ধান ভানতে গিয়ে বা এটা সেটার বাড়ি লেগে ভেঙে যায়, অনেকদিন কিনতে পারে না। কাঁচের জিনিস, কদিনই বা টেকে। আর টিকলেই বা কি এই সোনার ছড়া তো পরতে পারবে না, একটা আয়নাও নেই যে এখন পরে দেখে গলায় কেমন মানায়!