মোল্লা সিন্দুকের ওপরে ঝুঁকে ছিল, পরী ইতস্তত করলে অতর্কিতে হাত বাড়িয়ে ওর বাঁ হাত ধরে ফেলল। টেনে কাছে এনে আবার বলল, দ্যাখ কত জেওর।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও টেনে দেখে সত্যি সিন্দুকের ভিতরে এক প্রস্থ কাপড়ের ওপর অনেকগুলো সোনারূপার অলঙ্কার। চুড়ি বালা লটকন নাকফুল গোলখাউরা, সবই আছে। ধনু মোল্লা ডান হাত বাড়িয়ে একটা মাদুলি ছড়া তুলে আনল, ওকে দিতে গিয়ে বলল, গলাৎ পিনছান দেহি। র নানির জেওর।
পরী হাত ছাড়িয়ে পিছিয়ে গিয়ে বলল, না। মাইষে দেখলে কি কইবো।
আ লো মাইন্ যে দেখবো না। মোল্লা কাছ গিয়ে ফিসফিস করে বলল, তরে আমার খুব ভাল লাগে পরী, তুই যদি রাজি অস—
পরী কথাটা শুনল না, একদৌড়ে বেরিয়ে গেল। পরক্ষণেই ছোট বৌ ঘরে ঢুকলে মোল্লা তেতো-স্বরে বলল, যহন তহন আমার ঘরে আও ক্যারে বৌ? যাও যাও।
তারপর তাড়াতাড়ি সিন্দুকের ডালাটা নামিয়ে চাবি লাগিয়ে দেয়। দুষ্ট বৌ ঠোঁটের তলে মিটিমিটি হাসে। রান্নাঘরে গিয়ে কি বললে মেয়েদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল।
মণ্ডা মিঠাইয়ের দিকে পরীর লোভ একেবারে ছোটবেলার, যেখানেই দেখুক জিভে পানি এসে পড়ে। তেলের পিঠা বানাবার জন্য বেলায় বাজার থেকে এক চাক্কা। আখের গুড় আনা হয়েছিলো, ওপরে বেতের ঢাকনা দিয়ে বড়ঘরেই একটা খাদার মধ্যে রেখেছে। আনার পর বারান্দায় রেখেছিল, তখনই ও দেখেছে, কি সুন্দর রং! মিহি দানা! অন্য কাজ করলেও তাকে তাকে রইল, এবং এক সময় সকলে যখন অন্যদিকে ব্যস্ত তখন ঘরে ঢুকে খামছা দিয়ে ভেঙে এক খাবলা তুলে নেয়, এরপর সিন্দুকের ওধারে এক রক্তি হয়ে বসে ফুলে ওঠা মুখটা নাড়তে থাকে। চোখের মণিদুটো ছোট্ট পাখির মতো চঞ্চল। কেউ এসে দেখে ফেললে রক্ষে নেই।
সামনের দরজাটা ভেজানো ছিল, খানিকক্ষণ পরে আসবি তো আস একেবারে ধনু মোল্লা স্বয়ং। কোমর থেকে চাবি খুলতে খুলতে সিন্দুকের কাছে গেল।
পরী দ্বিতীয়বার গুড় নিয়েছিল, তাড়াতাড়ি গেলবার চেষ্টা করতেই খুকখুক করে কেশে ওঠে এবং কিছু ছিটকে পড়ে কাছাকাছি। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা আঁচ করতে মোশ্লার দেরি হল না। হেসে বলল, আরো খাইবি, দিমু নাকি?
পরী জবাব দেবে কি লজ্জায় ওর কানের পাতা দুটো লাল হয়ে গেল। মাথার চুলে খস খসে হাতে আদর করে তাকে ছেড়ে দেয় ধনু মোল্লা।
সেদিনই সন্ধ্যার পরে পরী যখন রান্নাঘরে তরকারিতে জ্বাল দিচ্ছিল, হঠাৎ কাশতে কাশতে মোল্লা গিয়ে হাজির। তার হাতে নারকেলের ডাবা, মাথায় গোল টুপি। ঝাপের কাছে চৌকিতে বসে কলকেটা খুলল, তারপর সেটাতে আগুন নিতে যাওয়ার অছিলায় ফতুয়ার জেবের ভেতর থেকে একটা পোঁটলা বার করে পরীর কোলে গুঁজে দিল, কাঁপাস্বরে বলল, তর লইগা আনছি, মিডাই!
পরী মাথা ঝাঁকানির সঙ্গে সেটা ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু পারল না। এদিকে কে আসছে টের পেয়ে কাপড়ের নিচে লুকিয়ে ফেলে।
সেদিন পানি তুলতে গিয়ে অন্ধকারে কুয়ার কাছে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা রসগোল্লা খেতে কি মজাই না লেগেছিল। কিন্তু আস্কারা পেয়ে তার ফল যে এতটা গড়াবে ওর ছোট্ট মাথায় তখন তা মোটেই ঢোকেনি।
ধনু মোল্লা প্রথম দুই আঙুলে নাক টিপে ধরে আন্দাজ করল ওর ঘুমের পরিমাণটা কত, খানিকক্ষণ শাসরোধ হওয়ার একটু নড়ে উঠতেই কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপাস্বরে ডাকল, ‘পরী! ও পরী পরী গো।
স্পষ্ট জেগে থাকলেও সে সাড়া দেয় না। এরপর কাঁধে খসখসে হাতের অবিরত ঢাকুনি খেয়ে একবার উচ্চারণ করল, ‘উঃ।
পরী! পরী। আবার কানের কাছে গড়গড় গলার স্বর, পরী! পরী! ধনুমোল্লা হালকা নরম পুতুলটির মতো ওকে ধরে তার বিশাল কোলের ওপর তুলে নিল। এবার পরী চুপ থাকতে পারে না, ঘুম জড়িত গলায় সে বলল, ক্যাডা? নানা?
আ লো অহন নানা কইনা। আমি ধনা গাজি! মোগ্লা আদর করে বলল, রইম্যা হালা তরে খুব মারছে আমি তেল আনিছি মালিশ করবার লাইগ্যা। পরীর গায়ে জামা নেই, মোল্লা কাছেই রাখা বাটি থেকে সরষের তেলে আঙুলসহ ডান হারে পাতাটা ভিজিয়ে নিয়ে ওর খালি পিঠে বোলাতে থাকে। চিচি করে বলল, আপনে এতা কি করতাছে! কেউ টের পাইলে আপনার মান থাকব না!
রাইখ্যা দে মানসম্মান। তোরে কোলে নিয়া আমার জীবন ধন্য অইছে ইজ্জত যায় যাকগা!
পরী জিজ্ঞেস করলো, নানীরে পছন্দ করতেন না?
করতাম খুইব, ভালো বাইতাম। ধনু মোল্লা ওর কোমরের কাপড়টা সরিয়ে দিয়ে মালিশ করতে করতে বলল, কিন্তুক হেইতে মইরা গেছে গা।
খুলে গিয়েছিল, পরী কাপড়টা নাভি পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেরো দিয়ে পরতে থাকে। হঠাৎ খেয়াল করে বেশ একটা সুগন্ধ। জিগগেশ করলো, কিয়ের খুশবু নানা?
মোল্লা অন্ধকারে খলখল করে হাসে। বলল, তুই একদিন কইছিলি না আমার গতরে বঁই করে? হের লাইগ্যা আর মাখছি।
তেলের হাতটা লুঙিতে ভালো করে পুছলে বোঝা গেল মালিশ করা শেষ হয়েছে। মোল্লা জেকের ভিতর থেকে একটা পোঁটলা বার করে। খুললে টিনটিন শব্দ হল। সেই মাদুলি ছড়াটা। পাঁচভরি পাকা সোনার তৈরি ছয়টা মাদুলি আর নয়টা দুগদুগি। বৌয়ের জেওর, রশুনটা তামাকটা বিক্রি করে নিজেই বানিয়ে দিয়েছিল। গলা হাতড়ে সেটা ওকে পরাতে গেলে হাতে বাধা দিয়ে বলল, না নানা। আপনের পায়ে পড়ি, আমারে ছাইড়া দ্যা। আমি যাইগা বাড়ি।