ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনার লেখার মধ্যে এমনিতে মোটা দাগে কোনো ফর্মুলা খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু অনেক সময় আপনাকে পাঠক ধরে রাখার কিছু সহজ কৌশল অবলম্বন করতে দেখি। ধরা যাক, সাধারণ একটা লোকজ ধাঁধা আপনি বইয়ের শুরুতে ব্যবহার করছেন। যার উত্তর মেলে বইয়ের শেষের দিকে। এটা কি সচেতনভাবে করেন?
হুমায়ূন আহমেদ: এটা আসলে পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখার জন্য করি। একটা পৃষ্ঠা পড়ার পর পাঠক যাতে পরের পৃষ্ঠাটা পড়ে। কৌশলটা যে খুব ভালো, তা বলব না। তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস। প্রথম দেড় শ পৃষ্ঠা আমার কাছে খুবই একঘেয়ে মনে হয়েছে। পাতার পর পাতা শুধুই একটা পার্টির বর্ণনা। কিন্তু যখন তুমি গল্পটার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছো, তখন তুমি বারুদের গন্ধ পাবে। যুদ্ধটাকে অনুভব করতে পারবে। আমি প্রথম পৃষ্ঠায় আটকে ফেলতে পেরেছি, তার মানে আমি বিরাট লেখক এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির একটা বই পড়ছি। পড়ে মুগ্ধ হলাম। তার গল্প বলার ধরন অসাধারণ। খুব সহজ কথা বলছে, কিন্তু একই সঙ্গে এত গভীর কথা বলে যাচ্ছে।
আলীম আজিজ: আপনি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন?
হুমায়ূন আহমেদ: , ঈশ্বরবিশ্বাস আমার আছে। ধরা যাক, তুমি একটা গ্রহে গেছ। গ্রহটা দেখে তোমার মনে হতে পারে, চিরকাল ধরে গ্রহটা একই রকম আছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তুমি যদি একটা নাইকন ক্যামেরা দেখ, তোমাকে সেটা হাতে নিয়ে বলতেই হবে, এটার একজন কারিগর বা মেকার আছে।
সামান্য একটা প্লাস্টিকের ক্যামেরা দেখে তুমি বলছো এর একটা মেকার আছে। ক্যামেরার কিন্তু অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তোমার পেছনে একটা মানুষ আছে। ক্যামেরায় পেছনের মানুষটাকে ফোকাস করার সঙ্গে সঙ্গে তুমি হয়ে যাবে আউট অব ফোকাস। আবার তোমাকে ফোকাস করার সঙ্গে সঙ্গে পেছনের জন হবে আউট অব ফোকাস।
মানুষের চোখের কিন্তু এই অসুবিধে নেই। চোখ ক্যামেরার চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী। আমাদের শরীরে একটা যন্ত্র আছে, যার কাজ শরীরের সুগার-লেভেল ঠিক রাখা। মানুষের পুরো শরীর এমন বিচিত্র আর জটিল যন্ত্রপাতিতে ভরপুর। এসব জটিল ব্যাপার এক দিনে এমনি এমনি হয়ে গেছে, এটা আমার মনে হয় না। ‘ডারউইন থিওরি’ কী বলে? বলে, সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট। বলে, পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে মানুষের সামনে নানা রকম বিপত্তি আসবে, সেগুলো জয় করতে গিয়ে আমরা এ রকম হয়ে গেছি। পশুর চোখ কিন্তু হলুদ। আর আমাদের চোখ সাদা। এটা হয়েছে, যাতে মানুষ অন্ধকারের মধ্যে নিজেরা নিজেদের চিনতে পারে। আমাদের টিকে থাকার জন্য এইটুকু জ্ঞানই তো যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মানুষের মাথায় এই জ্ঞান কীভাবে এল যে সে রীতিমতো ‘বিগ ব্যাং থিওরি’ আবিষ্কার করে ফেলল? এই এক্সট্রা-অর্ডিনারি জ্ঞানটা মানুষকে কে দিল? খেয়াল করলে দেখা যাবে, মানুষ সবার আগে যে বাড়িটা বানায়, সেটা একটা প্রার্থনাকক্ষ। সব জাতির মানুষের ক্ষেত্রেই তা-ই। তার মানে, সেই একদম শুরু থেকেই মানুষ আসলে একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত—হু ইজ গাইডিং মি?
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: মৃত্যুর পরবর্তী জগত্ নিয়ে আপনার নিজের চিন্তাভাবনা কী?
হুমায়ূন আহমেদ: এই বিষয়ে আমার প্রবল একটা আগ্রহ সব সময় ছিল। একবার আমি চেষ্টা করলাম প্রার্থনা করব। প্রতিদিন একটা সময়ে বসি। পৃথিবী থেকে বিদায়মুহূর্তটা কেমন হবে, এটা জানা যায় কি না চেষ্টা করি। দিনের পর দিন এটা চলল। তখন আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্ন আমাকে দেখানো হলো। অথবা আরেকটা ব্যাপার হতে পারে, দিনের পর দিন একটা ব্যাপার চিন্তা করার ফলে আমার মস্তিষ্ক সেটা তৈরি করল। অনেক বড় বিজ্ঞানীর বেলায়ও এটা হয়েছে।
আমি কী স্বপ্নে দেখেছি সেটা বলি—
বিশাল একটা হাওর। হাওরের মধ্যে পানি, পানি আর পানি। কলাগাছের মতো একটা জিনিস ধরে আমি ভাসছি। পানি অল্প ঠান্ডা। কলাগাছের মতো জিনিসটা মনে হচ্ছে একটা যান। সেটা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। কিছুদূর গিয়ে মনে হলো—মাই গড! এ তো আনন্দের পৃথিবী ছেড়ে আমি চলে যাচ্ছি! সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা বন্ধ হলো। আবার ফিরে এলাম। আমার এই বাড়িঘর—সব আগের মতো। আমি দেখলাম। তখন আমার মনে হলো—আর কী? এবার যাই। আমার যাত্রা আবার শুরু হলো। অনেক দূর গিয়ে আবার মনে হলো—ও মাই গড! সব ফেলে আমি কোথায় যাচ্ছি! আবার ফিরে এলাম। তারপর আবার মনে হলো—এই তো সব। আর কী? এরপর যানটা একটা অকল্পনীয় গতিতে ছুটতে শুরু করল। কোন দিকে যাচ্ছি, কিছুই বুঝতে পারছি না। দূরে ছোট্ট একটা আলো।
এটাই হচ্ছে আমার অভিজ্ঞতা। হতে পারে, আমার মস্তিষ্ক এটা তৈরি করেছে। আবার না-ও হতে পারে।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: মেঘের ওপর বাড়ি বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্রকে আমরা দেখি, নিয়ন্ত্রণ করছে অন্য একজন।
হুমায়ূন আহমেদ: আমরা তো সাধারণ মানুষ। রবীন্দ্রনাথ কী বলে গেছেন? বলে গেছেন, আমি তো লিখি না, জীবনদেবতা আমাকে দিয়ে লেখান। আবার, এমনও হতে পারে, আমরা খুব অসহায় বোধ করি বলেই একজন বড় পথনির্দেশকের কথা চিন্তা করি।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনি দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। দেশটা আপনার কেমন লাগে?
হুমায়ূন আহমেদ: ওখানে যাওয়াটা আমার জন্য ভয়ের ব্যাপার। দীর্ঘ বিমান ভ্রমণ খুবই ক্লান্তিকর। আর বিমান ভ্রমণ আমার জন্য এমনিতেই আতঙ্কজনক। কারণ আমার উচ্চতাভীতি আছে। সারাক্ষণ মনে হতে থাকে—এই বুঝি সব ভেঙেচুরে নিচে পড়ে যাব।