হুমায়ূন আহমেদ: আমি সেটা জানি না৷ অতি জটিল একটা বিষয় নিয়ে বাংলায় মজা করে লেখার চেষ্টা করেছি৷ অনেকেই সায়েন্সফিকশন মনে করে এই বই কিনে নিয়ে ধরা খেয়েছে৷
মিলন: এই বইটি কি আপনার ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে সেইভাবে পপুলার হয়েছিল?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি যতদিন ক্লাস নিয়েছি ততদিন তারা এই বইটি পড়েছে৷
মিলন: আপনি এমন একটি দুরূহ বিষয়ের টিচার হবার পরও এত জনপ্রিয় একজন লেখক হয়ে গেলেন, এই বিষয়ে আপনার ছাত্র-ছাত্রীদের আগ্রহ বা প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
হুমায়ূন আহমেদ: আমার প্রতি আগ্রহ তাদের বেশ ভালোই ছিল৷ রসায়ন অনার্স ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রী কম, হঠাত্ দেখি আমার ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রী বেশি বেশি লাগছে৷ ছাত্রসংখ্যা বড় জোর ৩০ হলেও, দেখা যেত উপস্থিত আছে ৪২/৪৩ জন৷ দেখা গেল, এরা কেমিস্ট্রির ছাত্র না৷ কেউ জিওগ্রাফির, কেউ সয়েল সায়েন্সের, আবার দেখা গেল কেউ কেউ এসেছে আর্টস ফ্যাকাল্টি থেকে৷ ওরা এসেছে জাস্ট দেখার জন্য, এই লেখক মানুষটি কীভাবে ক্লাস নেয়৷ এটি যখন মোটামুটি জানাজানি হয়ে গেল তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে বলা হলো, আমি যেন আমার ক্লাসে বাইরের কাউকে এলাউ না করি৷ কাজেই পরবর্তীতে ক্লাস নেবার শুরম্নতে দেখে নিতে হতো, ক্লাসের ছাত্র কারা আর ক্লাসের বাইরের ছাত্র কারা৷
মিলন: ছোটদের জন্য লেখালেখি নিয়ে আপনার ভাবনা কী? প্রথম ছোটদের জন্য কবে থেকে লেখা শুরম্ন করেন?
হুমায়ূন আহমেদ: প্রথম লেখাটা বোধহয় ‘নীল হাতি’৷ কবে বের হয়েছিল সেটা ঠিকঠাক বলতে পারব না৷ অবজারভার গ্রম্নপ বাচ্চাদের জন্য একটা পত্রিকা বের করেছিল৷ পত্রিকাটির নাম বোধহয় ‘কিশোর বাংলা’৷ ওটার প্রথম সংখ্যার জন্য লেখাটা দিলাম৷ ভয়ে ভয়ে ছিলাম, বাচ্চাদের জন্য প্রথম লেখা তোঃ কেমন হয় ? ওটাই আমার প্রথম লেখা বাচ্চাদের জন্য৷ তারপর আমার নিজের বাচ্চারা যখন বড় হলো, তখন ওদের পড়ার জন্য ওদের উপযোগী করে বেশ ক’টি লেখা দাঁড় করাই৷ ওগুলোতে বেশিরভাগ চরিত্রগুলোর নাম ওদের নামেই- নোভা, শীলা, বিপাশা, নুহাশ৷ একটা সময় বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রচুর বাচ্চাদের বই লিখি৷ বাচ্চারা কিন্তু কঠিন পাঠক৷ বাচ্চাদের মা-বাবা আমাকে ধমক দিতে ভয় পায়৷ কিন্তু বাচ্চারা পায় না৷ তারা ধমক দিয়ে আমাকে বলে, কী ব্যাপার, নতুন বই কই? বই নাই কেন? তখন আমি খুব আনন্দ পাই৷ আমি তখন তাদের বলি, আগামী বইমেলায় তোমাদের জন্য নতুন একটা বই থাকবে৷ ওদের মুখের দিকে তাকিয়েই আমাকে কথা রাখতে হয়৷
মিলন: আপনারা তিনভাই তিনবোন৷ আপনার এক ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল একজন বড় মাপের লেখক৷ আরেক ভাই আহসান হাবীব কার্টুন এঁকে রম্য লিখে বিখ্যাত হয়েছেন৷ একই পরিবারের তিনজন মানুষ তিনরকমভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন৷ এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি কেমন?
হুমায়ূন আহমেদ: এরা প্রত্যেকেই নিজ যোগ্যতায় আজকের পর্যায়ে পেঁৗছেছে, নিজস্বভাবেই তারা প্রতিষ্ঠিত৷ এরা প্রত্যেকে আলাদা মানুষ৷ সাধারণভাবে একই পরিবারে দুই-তিনজন লেখক তৈরি হলে একজনের ছাপ অন্যজনের ওপর পড়ে৷ এটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু আমার ভাইদের মধ্যে ছাপের কোনো ব্যাপার নাই৷ জাফর ইকবাল লিখছে একেবারে তার নিজস্ব স্টাইলে৷ আমার লেখার কোনো ছাপ তার মধ্যে নাই৷ আহসান হাবীব লিখছে সম্পূর্ণ তার মতো করে৷ ছবি-টবি অাঁকছে তার নিজস্ব চিনত্মা থেকে৷ বড় দুই ভাইয়ের কোনো ছাপ তার মধ্যে নাই৷ প্রত্যেকেই প্রত্যেকের আলাদা জায়গায় কাজ শুরম্ন করেছে এবং ভালো কাজ করছে৷ আমরা ভাইবোনেরা ইনক্লডিং মাই সিস্টার্স, যারা লেখালেখির লাইনে আসে নাই- এরা প্রত্যেকেই যে কাজটি করে খুব সিনসিয়ারলি করে৷ এটা আমাদের পারিবারিক গুণ বলা যেতে পারে৷ আমরা ভাইবোনেরা কোনো কাজ হাতে নিলে সেটা ঠিকভাবে করব, এটা স্বতঃসিদ্ধ৷
মিলন: বাংলা ভাষায় আপনার প্রিয় লেখক কারা কারা ? যাদের লেখা আপনি সবই প্রায় পড়েছেন ?
হুমায়ূন আহমেদ: একদম শুরম্ন থেকে বলি৷ বঙ্কিমচন্দ্র৷ কেননা তাঁর গল্প তৈরির ৰমতা অসাধারণ৷ তারপর আমাদের শরত্চন্দ্র৷
মিলন: একটি ভিন্ন বিষয়ে আপনাকে প্রশ্ন করতে চাই৷ বিষয়টি হলো ‘মৃতু্য-চিনত্মা’৷ আমি জানি যে, আপনি মৃতু্য নিয়ে ভাবেন৷ জাগতিক বিষয়ের পাশাপাশি মৃতু্য-পরবর্তী জগত্ নিয়েও আপনি ভাবেন৷ আপনার মৃতু্য-চিনত্মাটা কী রকম?
হুমায়ূন আহমেদ: আমি থাকব না, এই পৃথিবী পৃথিবীর মতো থাকবে৷ বর্ষা আসবে, জোছনা হবে৷ কিন্তু সেই বর্ষা দেখার জন্য আমি থাকব না৷ জোছনা দেখার জন্য আমি থাকব না৷ এই জিনিসটি আমি মোটেও নিতে পারি না৷ আগেও কখনো পারতাম না, এখনো যতই ঐদিকে এগিয়ে যাচ্ছি ততই আর পারছি না৷
মিলন: বড় লেখকদের ৰেত্রে কালজয়ী শব্দটা বাংলা ভাষায় আছে৷ যারা সময়কে জয় করে নেন নিজের লেখার মধ্য দিয়ে৷ আপনি আপনার লেখার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন, এই ফিলিংসটা আপনার কেমন?
হুমায়ূন আহমেদ: এই বিষয়টা একেবারেই আমার মাথায় আসে না৷ আমিই নেই আর আমার লেখা লোকজন পাঠ করছে, এতে আমার কী যায় আসে?
মিলন: কিন্তু এরকম কি কখনো মনে হয় না, আমার যে লেখাগুলো আমি রেখে যাচ্ছি, তার মধ্যেই আমি বেঁচে থাকব, লোকজন আমাকে স্মরণ করবে?
হুমায়ূন আহমেদ: না, সেরকম মনে হয় না৷ মিলন, আমি তোমাকে সিরিয়াসলি বলছি, আই অ্যাম টেলিং ইউ ফ্রম মাই হার্টঃ এই চিনত্মাটা কখনো আমার হয় না যে, ৫০ বছর পর লোকে আমার লেখা পড়বে, আমি কত ভাগ্যবান! আমি সারাজীবন লেখালেখি করেছি নিজের আনন্দের জন্যে৷