মিলন: আপনি তো বহু বিষয়ে ইন্টারেস্টেড৷ এর মধ্যে আপনার একটি খুব প্রিয় বিষয় হচ্ছে ভূত এবং বহু স্মরণীয় ভূতের গল্প লিখেছেন আপনি৷ আপনার ছোট ছোট অনেক অভিজ্ঞতার কথা জানি আমরা৷ এই ভূত ব্যাপারটা নিয়ে আপনার বিশ্বাসটা কি?
হুমায়ূন আহমেদ: বিশ্বাসটা হলো- আমি মনে করি না ভূত বলে কিছু আছে৷ ভূত না থাকলেও ভূতের ভয় আছে৷ ভূতের ভয় আছে বলেই ভূতের গল্প আছে৷
মিলন: তাহলে কী বলব? আপনি বানিয়ে বানিয়ে লিখেন?
হুমায়ূন আহমেদ: গল্প-উপন্যাস মানেই কি বানানো বিষয় না ? গল্প-উপন্যাস তো ইতিহাস না৷ তারপরেও কিছু কিছু ব্যাপার ঘটেও যায়৷
মিলন: আপনি লেখালেখির শুরম্নর দিকে কবিতা লিখেছেন, আপনার বোনের নামে সেগুলো ছাপা হয়েছে এবং হুমায়ূন আহমেদ নামেও একটি কবিতার কার্ড ছাপা হয়েছে৷ তাতে কি আপনার কবিতার প্রতি তীব্র টান প্রকাশিত হয় না?
হুমায়ূন আহমেদ: আমি একটি উপন্যাস লিখেছি৷ নাম ‘কবি’৷ তারাশঙ্করও এই নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন- বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর মধ্যে এটি একটি৷ সেইখানে আমার মতো একজন লেখকের আরেকজন কবিকে নিয়ে উপন্যাস লেখার ব্যাপারটি কি দুঃসাহসিক নয়? তারাশঙ্করের কবি ছিলেন সেই সময়ের কবি, আর আমার কবি হচ্ছে আজকের কবি৷ তাদের জীবনবোধ, জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে৷ তারাশঙ্করের কবি ছিল অতিদরিদ্র, আমার কবিও অতিদরিদ্র৷ দু’জনের মধ্যেই কাব্য প্রতিভা আছে৷ এই জিনিসটাকে নিয়েই লেখালেখির চেষ্টা করেছিলাম আর কি৷ তো এই উপন্যাসের জন্যেই কবিতার দরকার পড়ল৷ কাকে বলবো? ভাবলাম আমিই লিখি৷ একইভাবে আমার একটি টিভি সিরিয়ালে গ্রাম্য গায়কের কিছু গানের দরকার ছিল৷ নাটকের গান তো, সিকোয়েন্স অনুযায়ী লিখতে হয়, কাকে দিয়ে গান লেখাবো? নিজেই লিখলাম৷ দায়ে পড়ে আর কি! আমি হলাম দায়ে পড়ে কবি, দায়ে পড়ে গীতিকার৷
মিলন: ‘কবি’ উপন্যাসে যে টুকরো টুকরো কবিতার লাইন ব্যবহার করেছেন বা আপনার প্রথম উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এ যে কবিতার লাইনগুলো রয়েছে- ‘দিতে পারো একশ’ ফানুস এনে/ আজন্ম সলজ্জ সাধ একদিন আকাশে ফানুস ওড়াই৷’ এটা একজন কবির লেখা কবিতা- তা আপনি যতই ঠাট্টা-তামাশা করম্নন না কেন! কবিতার ছন্দ, শব্দের ব্যবহার এসব নিয়েও আপনি অনেক ভেবেছেন৷ এ ব্যাপারে আপনার ব্যাখ্যা কী?
হুমায়ূন আহমেদ: না, আমি কোনো ব্যাখ্যায় যেতে চাচ্ছি না৷ আমি নিজেকে একজন গল্পকার মনে করি এবং গল্পকার পরিচয়েই আমি অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি৷ কবিতাকে বলা হয় সাহিত্যের ফাইনেস্ট ফর্ম৷ এই ফাইনেস্ট ফর্মে কাজ করার ৰমতা আমার নেই৷ গদ্যটা হয়তো খানিকটা লিখতে পারি৷ কবিতা নিয়ে মাঝে মাঝে একটু চেষ্টা চলতে পারে, তাই বলে নিজেকে কখনোই আমি কবি বলি না৷ সেই প্রতিভাও আমার নেই৷
মিলন: স্বাধীনতাউত্তর সময়ে এদেশের সাহিত্যের দুটি শাখা খুবই ডেভেলপড্- কবিতা ও মঞ্চনাটক৷ এদেশের কবিদের সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
হুমায়ূন আহমেদ: বাংলাদেশের সাহিত্যে যারা কবিতা লিখছেন- আগে যারা লিখেছেন, এখন যারা লিখছেন- তাদের কাব্য প্রতিভা সম্পর্কে আমার কোনো সংশয় নেই৷ বাংলাদেশ কবির দেশ৷
মিলন: দু’চারজন পছন্দের কবির কথা কি বলবেন?
হুমায়ূন আহমেদ: আমার প্রিয় কবিদের মধ্যে অনেকেই আছেন- শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ আছেন৷ এছাড়া রয়েছেন আল মাহমুদ- এখন তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস কবিতাকে কতখানি ৰতিগ্রসত্ম করেছে, সেই প্রসঙ্গে আমি যাচ্ছি না৷
ইমদাদুল হক মিলন: সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
হুমায়ূন আহমেদ: কবিতার চেয়ে তাঁর গদ্য আমার বেশি পছন্দ, তার পরেও তিনি যে কবি সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই৷
মিলন: আপাতদৃষ্টিতে আপনি একজন গম্ভীর মানুষ৷ আপনার সঙ্গে কিছুৰণ মেশার পর বোঝা যায়, আপনি অসম্ভব একজন ঠাট্টা প্রিয় মানুষ৷ আপনি ঠাট্টা করেন, মজা করেন, চমত্কার গল্প বলতে পারেন৷ এই গুণগুলি কি আপনার ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়েছিল?
হুমায়ূন আহমেদ: আমাদের ভাই-বোনদের প্রত্যেকেই খুবই গল্পবাজ৷ আমার মাও গল্প করতে খুবই পছন্দ করেন৷ আমার বাবাও গল্প-গুজব করতে পছন্দ করতেন৷ ব্যাপারটা হয়তোবা জিনের মাধ্যমে এসেছে, জেনেটিক্যালি এসেছে৷ আর গম্ভীর টাইপের মানুষ যেটা বলেছো, আমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছি, ২০ বা ২১ বছরের মতো, অধ্যাপকদের মুখে তো সবসময় একটা আলাদা ভাব তৈরি করে রাখতে হয়৷ কিছুৰণের মধ্যেই সেই চামড়াটা ফেলে দিয়ে অরিজিন্যাল হুমায়ূন আহমেদ যখন বেরিয়ে আসে, তখন মনে হয় লোকটা খারাপ না৷
মিলন: আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন কতদিন? ঐ সময় ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? শিৰক হিসেবে আপনি কেমন জনপ্রিয় ছিলেন?
হুমায়ূন আহমেদ: আমি অধ্যাপনা করেছি প্রায় কুড়ি বছরের মতো৷ আমি জনপ্রিয় ছিলাম কি না, এটা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল৷ আমার কোনো ছাত্র-ছাত্রী পাওয়া গেলে ওদেরকে জিজ্ঞেস করলে ওরা হয়তো বলতে পারত৷ আসলে হয়েছিল কী, আমি শেষের দিকে এমন একটা সাবজেক্ট পড়াতাম যেটা ছিল খুবই জটিল৷ সাবজেক্টটা হচ্ছে, কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রি৷ যে সমসত্ম শিৰক এই সাবজেক্ট পড়ান তারা ছাত্রদের কাছে খুব দ্রম্নত আন-পপুলার হয়ে যান৷ কারণ এ ধরনের সাবজেক্ট খুব অ্যাবস্ট্রাক্ট৷ সাবজেক্ট অ্যাবস্ট্রাক্ট হওয়ায় কোনো ধরনের মেন্টাল ছবি দাঁড় করানো যায় না৷ অংকের সাহায্যে জিনিসটা বুঝতে হয়৷ আর এমনিতেই তো আমাদের কেমিস্ট্রির ছাত্রদের মেথমেটিক্স জ্ঞানটা একটু কম থাকে অর্থাত্ সেইভাবে জোরালো জ্ঞান মেথমেটিক্সের ওপর থাকে না৷ বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই বুঝতে পারে না, কী পড়ানো হচ্ছে৷ যখন বুঝতে পারে না তখন সাবজেক্টটার ওপর একটা বিতৃষ্ণা তৈরি হয়৷ যিনি পড়াচ্ছেন তার প্রতিও বিতৃষ্ণা তৈরি হয়৷ এই জিনিসটা আমার ৰেত্রে ঘটেছে কিনা আমি বলতে পারব না৷ আমি খুবই চেষ্টা করেছি, যতটা সম্ভব সহজভাবে এই অ্যাবস্ট্রাক্ট জিনিসটি বোঝানোর৷ আমার কাছে মনে হয়, হয়তোবা পেরেছি৷ আমার দিক থেকে এই জটিল বিষয় তাদের বুঝানোর চেষ্টায় খাদ ছিল না৷ আমি যখন দেখলাম কোয়ান্টাম মেথড ওরা বুঝতে পারছে না, আমি তখন এই বিষয়ে একটি বই লিখে ফেললাম বাংলায়৷ আমি এই বইয়ে যতটা পারি সহজভাবে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেছি৷ মিলন: আমার মনে আছে, এই বই বেরিয়েছিল কাকলী প্রকাশনী থেকে৷ ওরকম বই বাংলা ভাষায় আপনার আগে কেউ লিখে নি, এই তথ্যটা কি আপনি জানেন?