ইমদাদুল হক মিলন: আপনি লেখক৷ তাই লেখালেখি দিয়েই শুরম্ন করা ভাল৷ আপনার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ লেখা কি একেবারেই আচমকা? এর আগে আপনি কি কিছু লিখেছেন কখনো?
হুমায়ূন আহমেদ: কবিতা লিখেছি৷ দৈনিক পাকিসত্মান পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে৷ তবে নিজের নামে লিখি নি৷ কবিতাগুলি আমার ছোটবোন মমতাজ আহমেদ শিখুর নামে পাঠাতাম৷ তার নামেই ছাপা হতো৷
মিলন: উপন্যাসে আসার ঘটনাগুলো বলেন- এই ধরেন- কীভাবে শুরম্ন, কীভাবে আইডিয়াটা এলো মাথায়ঃ
হুমায়ূন আহমেদ: প্রথমে তো আমি লিখলাম ‘শঙ্খনীল কারাগার’৷ যদিও প্রথমে এটা ছাপা হয়নি, কিন্তু উপন্যাস প্রথমে লেখা হয়েছিল ‘শঙ্খনীল কারাগার’৷ কিছুই করার ছিল না সেই সময়৷ আমার ঠিকমতো মনেও নেই৷ তবে এই উপন্যাসটা আমার বাবা পড়েছেন- এটা আমার জন্যে খুবই আনন্দের একটা ঘটনা৷
মিলন: মানে আপনার হাতে লেখা কপিটাই পড়েছেন ?
হুমায়ূন আহমেদ: হ্যাঁ৷
মিলন: পড়ে কী বললেন ?
হুমায়ূন আহমেদ: আমাকে কিছু বললেন না৷ বাবার সঙ্গে আমাদের ভাইবোনদের দূরত্ব ছিল৷ বাবা সরাসরি আমাদের কিছু বলতেন না৷ ভায়া মিডিয়া কথা বলতেন৷ তাঁর যা বলার তিনি মা’কে বলতেন৷ মা আমাদের বলতেন৷
মিলন: তিনি আপনার মা’কে কী বললেন ?
হুমায়ূন আহমেদ: পৃথিবীর সমসত্ম পিতাই সনত্মানদের সামান্য প্রতিভাতেই মুগ্ধ হন৷ তিনিও হয়েছিলেন৷ তাঁর মুগ্ধতা যে উঁচু পর্যায়ে ছিল তার প্রমাণ পেলাম কিছুদিন পর৷ উনি তখন একটা রেডিও নাটক লিখে শেষ করেছেন৷ নাম ‘কত তারা আকাশে’৷ হঠাত্ সেই নাটকের পাণ্ডুলিপি আমার হাতে দিয়ে বললেন- তুই তোর মতো করে ঠিকঠাক করে দে৷ আমি আমার এক জীবনে অনেক সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছি- ঐ দিনের সাহিত্য পুরস্কার সব পুরস্কারের উপরে৷
ইমদাদুল হক মিলন: আমেরিকা থেকে আপনি ফিরে এলেন ‘৮৪-এর দিকে বোধহয় ? তার আগে, মাত্র চারটা বই লিখে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন৷ এটা একটা অবিস্মরণীয় ঘটনা৷ আপনি ফিরে এসে আবার লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হবার কথা ভাবলেন কী করে?
হুমায়ূন আহমেদ: হয়তো লেখালেখির বিষয়টা ভেতরে ছিল সবসময়৷ যদি ভেতরে থাকে তাহলে ‘লেখালেখি’ বিষয়টা মাথার গভীরে একধরনের চাপ দিতেই থাকে৷ এই চাপটা একটা কারণ হতে পারে৷ দেশে ফিরে এসেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছি৷ আবার আমি যে একজন লেখকও, ঐটাও তো মাথায় ছিল৷
মিলন: লেখালেখির ৰেত্রে বড় গ্যাপ পড়লে একটা অস্বসত্মি তৈরি হয়৷ আপনার সে অস্বসত্মিটা কি তৈরি হয়েছিল যে, এতদিন পরে আমি আবার শুরম্ন করলাম!
হুমায়ূন আহমেদ: এটা আসলে মনে করতে পারছি না৷ মনে হয় না ছিল৷ কারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যারা লেখালেখি করে, তারা এগুলো নিয়ে মাথা ঘামায় না৷ অনেকদিন লিখিনি তাতে কি হয়েছে? আবার লিখব৷ ইচ্ছা না করলে আবার বন্ধ করে দেব৷
মিলন: কিন্তু এই স্বতঃস্ফূর্ততা কি আপনার প্রথম থেকে ছিল নাকি আসত্মে আসত্মেঃ?
হুমায়ূন আহমেদ: না, আমার মনে হয় এটা শুরম্ন থেকেই ছিল৷ মাঝেমধ্যে এটা একটু কেটে গেছে, এটা বলতে পারো৷ কিছু কিছু লেখার ৰেত্রে খুবই চিনত্মা-ভাবনা করে লাইনগুলো লিখতে হয়েছে৷ একটা লাইন লিখে দ্বিতীয় লাইনটির জন্যে অপেৰা করতে হয়েছে৷ দ্বিতীয় লাইন আসি আসি করছে, আসছে না৷ এই অবস্থা৷
মিলন: এই যে দেশের বাইরে থেকে ফিরেই একটার পরে একটা বই আপনি লিখতে থাকলেন৷ তারপর ‘৮৫-তে আপনি ‘এইসব দিনরাত্রি’ শুরম্ন করেছিলেন৷ একটার পর একটা লেখা, পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করা, এই যে এই অবস্থাটা তৈরি হলো, এর পেছনে রহস্যটা কি বলে আপনার মনে হয়?
হুমায়ূন আহমেদ: এই অবস্থা যে তৈরি হয়েছিল, এই বিষয়টার একটা নরমাল আর একটা আধিভৌতিক ব্যাখ্যা আছে৷
মিলন: আপনি বলেন- আমরা দুটোই শুনি৷
হুমায়ূন আহমেদ: নরমাল ব্যাখ্যা হলো- আমি নাটক লেখা শুরম্ন করলাম৷ আমাদের দেশে নাটকের দর্শক তো অনেক বেশি৷ ‘এইসব দিনরাত্রি’ বহু লোক দেখা শুরম্ন করল এবং এরা মনে করল এই যে লোকটি নাটক লিখছে, তার একটা বই পড়ে দেখি না কেন! তারা বই কিনতে শুরম্ন করল৷ পাঠকদের আমার বইয়ের প্রতি আগ্রহী হবার পেছনে ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকটা কাজ করেছে বলে আমার নিজের ধারণা৷ একজন নতুন লেখক লিখবে আর সঙ্গে সঙ্গেই তার বই বিক্রি হবে- এটা তো হবার কথা না৷ আমার ধারণা আমার নাটক দেখে লোকজন আগ্রহী হয়েছে, একটা বই পড়ে হয়তো সেকেন্ড বই পড়তে চেয়েছে- এটা হতে পারে৷ আর আধিভৌতিক ব্যাখ্যা যেটা হলো- শহীদুলস্নাহ হলে যখন থাকি, তখন একসঙ্গে প্রকাশকদের কাছ থেকে আমি হঠাত্ কিছু বড় অংকের টাকা পেয়ে গেলাম৷ ২৫-৩০ হাজার টাকা৷ সেই সময় ২৫-৩০ হাজার টাকা অনেক টাকা৷ বই বিক্রির টাকা৷ তখনো বই লেখা বাবদ অ্যাডভান্স দেয়া শুরম্ন হয়নি৷ যেহেতু টাকা পেয়েছি, আমার খুব হাত উশখুশ করছিল টাকাটা খরচ করার জন্য৷ কাজেই করলাম কী গুলতেকিন এবং বাচ্চাদের নিয়ে গেলাম ইন্ডিয়াতে৷ এই টাকা শেষ না হওয়া পর্যনত্ম দেশ ভ্রমণ হবে এই হলো পরিকল্পনা৷ প্রথমে গেলাম নেপালে, নেপাল থেকে দিলিস্ন৷ ভাবলাম এত কাছে যখন এলাম মরম্নভূমি দেখে যাই৷ জয়সলমীরের উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম৷ জয়সলমীরের পথে পড়লো আজমীর শরীফ৷ এত নাম শুনেছি- পথে যখন পড়লই তখন ভাবলাম যে, আজমীর শরীফ দেখে যাই৷ আজমীর শরীফ গেলাম৷ আমার সবচেয়ে ছোট মেয়েটি, বিপাশা, সে খুবই বিরক্ত হয়ে গেল; বলল- কোথায় নিয়ে এলে? চারদিকে ফকির৷ ফকিরে ভর্তি জায়গাটি৷ বিপাশার বয়স তখন তিন সাড়ে তিন; আমি তাকে বোঝালাম যে, এখানে একজন অতি বড় সাধু মানুষের কবর আছে৷ এখানে এলে আলস্নাহর কাছে যা চাওয়া যায়, তা পাওয়া যায়৷ দেখা গেল যে, এই কথা শুনে মানসিকভাবে সে স্বসত্মি বোধ করলো৷ তখন তাকে নিয়ে গেলাম কবর জিয়ারত করতে, জিয়ারত শেষ করে চলে আসবো, দেখি বিপাশা দাঁড়িয়ে৷ ব্যাপার কী? বিপাশা বলল, আমি যেটা চেয়েছি সেটা তো পাইনি৷ না পেলে যাব না৷ আমি বললাম, মা, তুমি কী চেয়েছ? বিপাশা বলল, আলস্নাহর কাছে আমি এক হাজার বসত্মা টাকা চেয়েছি৷ এই টাকা না পাওয়া পর্যনত্ম এখান থেকে আমি যাব না৷ করবস্থানের পাশে রেলিংটা ধরে সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো৷ আমি ও তার মা তাকে নিয়ে টানাটানি করতে লাগলাম৷ না, সে এ জায়গা ছেড়ে নড়বে না৷ এদিকে বাংলাভাষাভাষী কিছু লোক ছিল, তারা খুবই মজা পেয়ে গেল৷ একটি মেয়ে এক হাজার বসত্মা টাকা আলস্নাহর কাছে চাইছে, না পাওয়া পর্যনত্ম সে যাবে না- এটা তো মজার বিষয়ই৷ তখন বিপাশাকে বোঝালাম যে, এখন টাকাটা পেলে বরং সমস্যা হবে৷ এতগুলো টাকা দেশে নিয়ে যেতে হবে৷ কান্নাকাটি না করে চলো দেশে যাই৷ দেশে গেলে টাকাটা পেয়ে যাবে৷ অবশ্যই পাবে৷ আমরা দেশে ফিরে এলাম৷ আসার পর পরই জলের মতো হুহু করে টাকা আসতে লাগল৷ কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করে লেখালেখি করে বিপুল অর্থ উপার্জন আপনি কীভাবে করলেন? আমি বলি, আমার ছোট মেয়ে বিপাশার কারণে করেছি- এখানে আমার কোনো হাত নেই৷