– না।
– আচ্ছা, তাঁর কোন গল্প-উপন্যাস কিংবা নাটকের ‘মা’-এর চরিত্রে আপনার চরিত্র কিংবা তার খণ্ডাংশ এসেছে বলে আপনার মনে হয়?
– কি জানি (হেসে)। আমার চরিত্র তো আমি বুঝতে পারি না, তবে ‘এই সব দিন রাত্রি’র সেই মা নাকি আমি- তো এটা অনেকেই বলেন। আমার তো মনে হয় না।
– আপনার চোখে হুমায়ূন আহমেদকে কী মনে হয়- একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, নাকি লেখক?
– লেখকটাই বেশি।
– তাঁর চরিত্রে একটা দোষের কথা বলুন।
– সে রাগে খুব বেশি। আবার রাগ থাকেও না বেশি সময়।
– তাঁর ছোটবেলার একটা ঘটনার কথা বলুন।
– আমরা তখন সিলেট মীরাবাজারে ছিলাম। আমাদের বাসার পাশেই ছিল গরুর ঘর। একদিন রাতে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বলে কি- মা, শুনে যাও, গরুরা কথা বলে। সে কিন্তু এখনও মাঝে মাঝে বলে যে গরুর কথা সে শোনে- এটা ওর পাগলামি, না অন্য কিছু, কিছুই বোঝা যায় না।
– আপনার সব ছেলেমেয়ের উপর কি আপনি সন্তুষ্ট?
– অবশ্যই।
স্ত্রীর সাথে হুমায়ূন আহমেদই সুযোগ দিলেন কথা বলার। প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর নাতনি গুলতেকিন আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার’ পড়ার পর ক্লাস এইটের ছাত্রী গুলতেকিন আহমেদ একটা চিঠি লেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ প্রভাষক হুমায়ূন আহমেদের কাছে। এরপর দেখা হয়। যোগাযোগ বাড়ে। ঘনিষ্ঠতার পরিণতিতে গুলতেকিন ১৯৭৬ সালে এসএসসি পাস করার পর হুমায়ূন আহমেদের ঘরণী হয়ে আসেন। তিন মেয়ে নোভা, শিলা আর বিপাশার মা- নিজেই মেয়েদের দায়িত্ব নেন। এদের নিয়ে তাঁর কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই। যে যা হতে পারে হবে।
তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম- আচ্ছা, আপনি বিয়ের আগে যখন হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরক’ কিংবা ‘শঙ্খনীল কারাগার’ পড়লেন তখন কি ও দুটোকে লেখকের আত্মজীবনীমূলক কিছু বলে মনে করতেন?
– কিছুটা মনে হতো।
– নন্দিত নরকের ‘খোশ’ নিভৃতভাবে একটা মেয়েকে ভালোবাসতো। সেই ভালোবাসা সে কোনো দিন মেয়েটিকে জানাবার সাহস পায়নি- তার ভালোবাসা আজীবন নিভৃতেই থেকে গেল। আচ্ছা সেই খোকাটির জন্য কি এখন আমার দুঃখ হতো? (হুমায়ূন আহমেদ তখন মিটমিট করে হাসছেন)
– তা তো হতো।
– বিয়ের পরও যদি কোনো নায়িকার প্রতি লেখকের অতিরিক্ত অনুভূতি দেখা দিত- আপনি কী করতেন?
– ওটা তো গল্পই। আর সত্যি সত্যি সে কিছু করলে তো খারাপ লাগতই।
– আচ্ছা, তাঁর (হুমায়ূন আহমেদের) কোনো এক গল্প-উপন্যাসে আপনার কোনো চরিত্র এসেছিল?
– খণ্ড খণ্ড এসেছে, পুরোপুরিভাবে নয়। [হুমায়ূন আহমেদ জবাব দিলেন, ‘এই সব দিন রাত্রি’তে নীলুর চরিত্রের সাথে ওর অনেক মিল ছিল]
– আচ্ছা, লেখালেখির ব্যাপারে আপনি হুমায়ূন আহমেদকে কিভাবে সহযোগিতা করেন?
– কখনো চা বানিয়ে দিই। তা ছাড়া ও লেখার সময় প্রচুর বানান ভুল করে, সেগুলোও ঠিক করে দিই।
– তাঁকে নিয়ে আপনার গর্ব হয়?
– কিছুটা তো হয়ই।
– আচ্ছা, মনে করুন একদিন এমন হলো যে তাঁর লেখা কেউ আর পড়ছে না- তখন আপনার মানসিক অবস্থা কেমন হবে?
– তখন যদি ও লেখা ছেড়ে সংসারের দিকে কিছুটা মন দেয়, তাহলে ভালোই হবে।
– একজন পাঠক হিসেবে তাঁর লেখা আপনার কেমন লাগে?
– ওর লেখা আমার সব সময়ই ভালো লাগে।
হুমায়ূন আহমেদ প্রচুর চা খান। দুবার চা খাওয়ালেন আমাদের। বিদায় নিয়ে আসার সময় বাবুকে আর আমাকে তাঁর দুটো সর্বশেষ প্রকাশিত বই (প্রথম প্রহরে) উপহার দিলেন। হাঁটতে হাঁটতেও কথা হলো কিছুটা। বললেন, উপন্যাস লেখার ব্যাপারে তিনি যেসব এঙ্পিরিমেন্ট চালিয়েছেন, এর সবটিই সার্থক। এ টেকনিক আবার সবাই ধরতে পারবেন না। যাঁরা উপন্যাস লেখেন, কেবল তাঁরাই পারবেন।
হুমায়ূন আহমেদ এখন ‘এই সব দিন রাত্রি’ নিয়ে উপন্যাস লেখায় ব্যস্ত। প্রতিদিন বিশ পৃষ্ঠা লেখেন আর বিশ পৃষ্ঠা প্রেসে দেন।
হাঁটতে হাঁটতে এক সময় একটা রাস্তা দুদিকে চলে গেল। অত্যন্ত অমায়িক ভঙ্গিতে বিদায় দিয়ে আমাদের অনিন্দ্য প্রকাশনীর পথ ধরলেন তিনি। আমরাও রিকশা খুঁজতে ব্যস্ত হলাম। চোখের আড়াল হতে হতে হুমায়ূন আহমেদকে ভালো করে আবার দেখে নিলাম। আমার ভেতরে তখন নজরুল ইসলামের গান বাজছে-
– ‘তুমি কেমন করে গান কর হে কবি?’
এতক্ষণে লেখক শিবির পুরস্কার, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, অলঞ্চ সাহিত্য পুরস্কার আর ওসমানী স্মৃতি পদক প্রাপ্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় (বর্তমানে) ঔপন্যাসিক অদৃশ্য হয়ে গেছেন।
[সংগ্রহ : আনোয়ার জাহান ঐরি, চলন্তিকা ডট কম।]
হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার
হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সময়ের অভাবনীয় এক জনপ্রিয় লেখকের নাম৷ কথাসাহিত্যে তার প্রতিভার বিসত্মার ঘটলেও, তিনি শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে৷ তারপর নাটক, ছোটদের জন্য লেখা, সাইন্সফিকশন, চলচ্চিত্র পরিচালনা- শিল্প-সাহিত্যের এমনি নানা বিষয়ে হাত দিয়েছেন এবং প্রতিটি ৰেত্রে ছাপ রেখেছেন অনন্যতার৷ এই অভাবনীয় জনপ্রিয় লেখকের সঙ্গে এক দীর্ঘ আলাপচারিতা ঘটে আরেক জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলন-এর৷ সেই দীর্ঘ আলাপচারিতার উলেস্নখযোগ্য অংশ ‘ইত্তেফাক সাহিত্য সাময়িকী’র পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হলো৷ ষাটতম জন্মদিনের প্রাক্কালে প্রকাশিত এই সাক্ষাত্কারটি পাঠকদের আরো আন্তরিকভাবে হুমায়ূন আহমেদকে চিনতে সহায়তা করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।