– যখন লেখেন, তখন আপনি কোন শ্রেণীর পাঠকের কথা বিবেচনা করেন?
– সায়েন্স ফিকশনগুলি কম বয়েসী পাঠক-পাঠিকাদের জন্যে লেখা। অন্যসব যখন লিখি তখন কোন শ্রেণীর পাঠকদের জন্য লিখছি তা মনে থাকে না। যাদের ইচ্ছা হয় পড়বে।
– আপনার লেখায় রাজনৈতিক কোনো বক্তব্য দেখা যায় না কেন?
– এখন থেকে দেখতে পারবেন।
– তার মানে রাজনীতি আসবে?
– হু।
মাথা নাড়েন হুমায়ূন আহমেদ।
– এটা কী ধরনের হতে পারে?
– আগেভাগে কিছু বলতে চাই না।
– এত দিন না আসার কারণ?
– এত দিন আমার ঝোঁক ছিল গল্প বলার দিকে। যে সমাজ, যে কাল এই গল্প তৈরি করেছে, তাকে অবহেলা করেছি। মনে হয়েছে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখই সব।
– আপনি কি মনে করেন যে প্রতিটি মানুষেরই রাজনীতি করা উচিত?
– অফ কোর্স। ইটস এ পার্ট অব আওয়ার লাইফ।
– ব্যক্তিগতভাবে আপনি কোন রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী?
– আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, প্রতিটি মানুষের অধিকার সমান।
ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ বিষয়ক কথাও হলো কিছুটা।
– বাংলাদেশের তরুণ লেখকদের মধ্যে কে আপনার প্রিয়?
– ইমদাদুল হক মিলন, মঞ্জু সরকার।
– প্রিয় ঔপন্যাসিক?
– সৈয়দ হক। শওকত ওসমান। শওকত আলী।
– কবি?
– শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ।
– নাট্যকার?
– হুমায়ূন আহমেদ।
– কবিতা?
– জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগে একদিন’।
– নাটক?
– নৃপতি (নিজের লেখা- ফেব্রুয়ারিতে প্রথম মঞ্চস্থ হবে)।
– ‘বাবা’ আপনার উপন্যাসে আসেনি?
– ‘বাবা’ আমার গল্প-উপন্যাসে অনেকবার, অনেকভাবে এসেছেন (শঙ্খনীল কারাগার)।
– সে হিসাবে মা কিন্তু কম আসেন…
– সম্ভবত আপনার কথা সত্যি নয়।
সব শেষে আহমেদকে প্রশ্ন করেছিলাম, নতুন লেখকদের জন্য আপনি কিছু বলুন।
– নতুন লেখকদের জন্য আমার একটাই কথা- পড়তে হবে, প্রচুর পড়তে হবে- সব লেখকের লেখা পড়তে হবে। তাতে ভাষার ওপর দখল আসবে- কোন লেখক কিভাবে চরিত্রগুলো নিয়ে ‘ট্রিট’ করছেন, সেটাও পরিষ্কার হবে। আবার চোখ-কানও খোলা রাখা দরকার। যেমন কোন পেশার লোক কিভাবে কথা বলে, কিভাবে হাঁটে-চলে এসবও দেখতে হবে। তা ছাড়া কবিতা পড়া থাকলে বোধ হয় ভাষার প্রতি দখলটা তাড়াতাড়ি আসে।
আমরা হুমায়ূন আহমেদকে ছেড়ে তাঁর মার সাথে কথা বলতে চাইলাম। মাকে পাঠিয়ে নিজে ভেতরে গেলেন। বেশ বর্ষিয়সী মহিলা, স্বাস্থ্যবান। সাদা কাপড়ের লাল ডোরার শাড়ি পড়ে আমাদের পাশে এসে বসেন। গল্প শুরু করলাম মিসেস আয়েশা আক্তারের সাথে।
– আপনার ছেলেমেয়েরা কে কী করেন?
– বড় ছেলে হুমায়ূন আহমেদ। মেজ ছেলে জাফর ইকবাল- আমেরিকায় পোস্ট ডক্টরেট করছে, সে বাচ্চাদের জন্য লেখে, তিনটা বই বেরিয়েছে। ছোট আহসান হাবীব- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোলে এমএসসি পাস করেছে এবার। সে আবার ভালো কার্টুন আঁকে- উন্মাদ না কি যে কার্টুন পত্রিকা- এটার সহকারী সম্পাদক সে। বড় মেয়ে সুফিয়া হায়দার- পিরোজপুর মহিলা কলেজের বাংলার অধ্যাপিকা, ওর হাজব্যান্ড উকিল। মেজ মেয়ে বিএসসি পাস করে ঢাকায় আছে, ওর হাজব্যান্ড মেজর। ছোট মেয়ে- রোকসানা আহমেদও খুব ভালো ছবি আঁকে- শংকর পুরস্কার পেয়েছে। ক্লাস এইট পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে, ডিফ অ্যান্ড ডাম্প স্কুলে- ও আবার বোবা, কথা বলতে পারে না।
– আপনার সব ছেলেমেয়েই প্রতিভাবান এবং সমাজে সুপরিচিত- এ জন্য আপনার কি গর্ব হয়?
– অবশ্যই।
– এঁদের এ সাফল্যের পেছনে আপনার কী অবদান আছে বলে মনে করেন?
– না, আমার কোনো অবদান নেই। ওরাই ওদের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে।
– আচ্ছা, আপনার বড় ছেলে হুমায়ূন আহমেদ ছোটবেলায় কেমন ছিলেন?
– ও খুব চালাক ছিল। কথা বলত বুড়ো লোকের মতো এবং সে বুঝতও অনেক বেশি। তা ছাড়া লেখাপড়ায় ও অত্যন্ত ভালো ছিল। ক্লাস এইটে বৃত্তি পেয়েছিল, ম্যাট্রিকে সেকেন্ড স্ট্যান্ড করেছিল। ওর বাবা ওর সব কাগজপত্র জমিয়ে রাখতেন ফাইলের ভেতর। যে কাগজগুলোতে ওর ছবি উঠেছিল, ওর নাম উঠেছিল সে কাগজগুলো আমার কাছে এখনও আছে। ওর বাবা বলতেন, ওগুলো আলমারির মধ্যে যত্ন করে রেখো, তোমার ছেলে একদিন খুব বিখ্যাত হবে, তখন কাগজের লোকরা এসব খুঁজতে আসবে।
– হুমায়ূন আহমেদ যে একদিন লেখকই হবেন- এটা আপনারা বুঝতে পেরেছিলেন?
– ওর বাবা বুঝেছিলেন।
– কিভাবে?
– ও তখন ঢাকায় চলে এসেছে- মহসীন হলের ছাত্র। একবার একটা উপন্যাস লিখে আনল। সম্ভবত ‘শঙ্খনীল কারাগার’। বাসার সবাই আমরা পড়লাম- কিন্তু তার বাবাকে পড়ানোর সাহস তার ছিল না। একদিন আমাকে দিয়ে সে লেখাটি তার বাবার কাছে পাঠাল। তারপর- আমার পাশ দিয়ে শুধু ঘুর ঘুর করে অর্থাৎ জানতে চায় তার বাপ এটা পড়ে কি বললেন। এ রকম দু-এক দিন যাবার পর এক রাতে সবাই যখন শুয়ে গেছে তখন তার বাবা তাকে ডাকলেন। খুব ভয়ে ভয়ে সে গেল। আমিও তখন ছিলাম। তার বাপ পাণ্ডুলিপিটা তার হাতে দিয়ে বললেন- ‘এটা যত্ন করে রেখে দিস। তুই একদিন খুব নামকরা লেখক হবি।’
– তাঁর বাবা কি তাঁর প্রকাশিত কোনো লেখা পড়েছেন?
– না, উনি তো একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ হলেন।
– হুমায়ূন আহমেদের লেখা আপনার কেমন লাগে?
– খুব ভালো। মনেই হয় না যে এটা ও লিখেছে। মনে হয় অন্য কেউ সম্ভবত।
– কোনোটা খারাপ লাগেনি?