– আচ্ছা ‘নীলু’কে আপনি চেনেন?
– না।
– এ নামটা কেন বার বার আপনার গল্পে-উপন্যাসে আসে?
– নামটা সুন্দর। [এ জায়গায় তাঁর স্ত্রী জানালেন, তাঁরা যখন আমেরিকায় ছিলেন তখন পাশের বাসায় এক শ্রীলঙ্কান পরিবার থাকত- ঐ বাসায় একটি মেয়ের নাম ছিল নীলু। হুমায়ূন আহমেদ হাত দিয়ে দেখালেন- এতটুকু (চার-পাঁচ বছরের) মেয়ে]।
– নীলগঞ্জই বা কেন আসে?
– সম্ভবত নীল থেকে।
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর এমন অনেক উপন্যাসও লিখেছেন, যেগুলোর শিরোনামে গল্প বেরিয়েছিল অনেক আগে। অথচ উপন্যাসকেও যে গল্পের পরিবর্ধিত রূপ বলা যাবে, এমনও হয় না। তবে কেন? হুমায়ূন আহমেদের সেই একই জবাব- নতুন নাম খুঁজে পান না। তাঁর মতে, নাম দেয়ার জন্যেই দেয়া। [তাহলে কি নামকরণের সার্থকতার কথা তিনি কখনো ভাবেন না?]
– আচ্ছা, আপনি এত বেশি লেখার সময় কখনও আপনার লেখার মান সম্পর্কে সন্দিহান হন না?
– হ্যাঁ, আমি প্রচুর লিখি। আবার না লিখেও থাকতে পারি। প্রথম চারটি উপন্যাস প্রকাশের পর আমি সাত বছর কিছুই লিখিনি। আবার হয়তো একটা সময় আসবে যখন কিছুই লিখব না।
– একঘেয়ে ঠেকায় এক সময় যদি কেউ আপনার লেখা না পড়ে, তখন আপনি কী করবেন?
– কী আর করব? মন খারাপ করা ছাড়া কিছু করার আছে কি?
– আচ্ছা, আপনি লেখেন কেন?
– বলা মুশকিল, তবে লিখতে ভালো লাগে।
– অমরত্ব পাওয়ার বিন্দুমাত্র আশায়ও কি আপনি লেখেন?
– না। অমরত্ব মহাপুরুষদের জন্য। আমি মহাপুরুষ নই, সাধারণ মানুষ।
– আপনি কি নিজেকে কখনও জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক বলে মনে করেন?
– যখন জানলাম আমার একই বইয়ের প্রথম মুদ্রণ এক মাসে বিক্রি হয়ে গেছে। [তবে এটা হালকা ধরনের ভৌতিক উপন্যাস, গর্ব করার মতো কোনো রচনা নয়।]
– নিজের কাছে আপনার পরিচয় একজন লেখক, নাকি শিক্ষক?
– লেখক।
– উপন্যাসের শিরোনামে রবীন্দ্র-জীবনানন্দ থেকে ধার করেন কেন?
– এঁদের কাছ থেকে ধার করতে আমার লজ্জা লাগে না বলেই।
– যদি বলা হয় ‘তোমাকে’ প্রেমের উপন্যাস [কভারে লেখা আছে] হিসেবে সার্থক নয়- আপনি কী বলবেন?
– কিছু বলব না।
– আচ্ছা, একটু অন্য ধরনের প্রশ্ন- ‘প্রেম’ ছাড়া ছেলেমেয়েদের বন্ধুত্ব হতে পারে?
– পারবে না কেন?
– দুটো ছেলে আর দুটো মেয়ের মধ্যে যে রকম বন্ধুত্ব হয়- একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যেও কি একই রকম বন্ধুত্ব হতে পারে?
– তা অবশ্য নয়, কারণ এখানে ফ্রয়েডীয় কিছু ব্যাপারস্যাপার আছে।
– তাহলে যে বললেন…
– আসলে ব্যাপারটা একটু জটিল। আপনি অন্য প্রশ্ন করুন।
– আপনার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা কোনটা?
– তিনটে উপন্যাস লিখে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়াটা আমার কাছে একটা স্মরণীয় ঘটনা। না, না, এটা লিখবেন না, তাহলে লোকজন মনে করতে পারে আমার গর্ব হচ্ছে- লিখুন গুলতেকিন (স্ত্রী)-এর সঙ্গে পরিচয়।
– দুঃখজনক ঘটনা?
– বাবার মৃত্যু।
এরপর কিছুক্ষণ আপ্যায়ন পর্ব সেরে আবার শুরু হলো। সাহিত্যবিষয়ক কিছু কথাবার্তা শুরু হলো।
– বাংলা সাহিত্যে কার কার লেখা আপনার প্রিয়?
– বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশংকর, বিমল কর, সতীনাথ ভাঁদুড়ি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
– শংকরকে কেমন লাগে?
– ভালো। ওঁর প্রথম দিকের কিছু উপন্যাস খুবই ভালো।
– বাংলা সাহিত্য ছাড়া বিদেশি কোনো সাহিত্য পড়েন কি? প্রিয় কে?
– এক সময় প্রচুর পড়েছি। এখনো পড়ি। প্রিয় হচ্ছেন- জন স্টেইন-বেক। রেমাক।
– বড় গল্প আর উপন্যাসের মধ্যে একটু অন্য রকম প্রশ্ন করলাম- আপনার মতে, পার্থক্য কোথায়?
– জানি না।
– ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এর মুখবন্ধে ‘নন্দিত নরকে’ ‘গল্প’ বলে উল্লেখ করলেন- অথচ এটা ‘উপন্যাস’ হিসেবে বিবেচিত এবং পুরস্কৃত- তাহলে ‘গল্প’ বলেন কেন?
– আমাকে এসব জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। এ জাতীয় প্রশ্ন করা উচিত সাহিত্যের ছাত্রকে। আমি একবার একটি বইয়ের সমালোচনা লিখেছিলাম ‘রোববার’ পত্রিকায়। পরে সবাই সেটাকে গল্প বলতে লাগল এবং আমিও আমার গল্পগ্রন্থে (আনন্দ বেদনার কাব্য) ঢুকিয়ে দিলাম।
– আপনাকে যদি উপন্যাসের সংজ্ঞা দিতে বলা হয় তাহলে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন?
– কোনোভাবেই করব না। আমি যদি জানতাম উপন্যাস কী, তাহলে তো নিজেই লিখতাম, যা লিখেছি তার কোনোটিই কি সত্যিকার অর্থে উপন্যাস হয়েছে?
– ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লেখার কোনো পরিকল্পনা আছে?
– হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধের উপর বৃহৎ ক্যানভাসে একটা উপন্যাস লিখব- এবং এ জন্য আমি পড়াশোনাও করছি।
– বঙ্কিম, শরৎ থেকে বর্তমান কালের উপন্যাসগুলোর ধারা অনেকখানি পরিবর্তিত- এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
– সময়ের প্রভাব। উপন্যাস তো সময়েরই ছবি। সময় বদলালে উপন্যাস বদলাবে।
– উপন্যাস সৃষ্টিতে বাস্তব অভিজ্ঞতা কতটুকু প্রয়োজনীয় বলে আপনি মনে করেন?
– অনেকখানি।
– একটা সার্থক উপন্যাসে কী কী গুণাবলি থাকা আবশ্যক?
– একটা সার্থক উপন্যাসে সমাজ ও কাল উঠে আসবে। লেখক একটি দর্শন দিতে চেষ্টা করবেন। উপন্যাস মানে তো শুধু গল্প নয়। গল্পের বাইরেও কিছু।
– সুন্দর গল্পের জন্য সুন্দর কাহিনীই কি অত্যাবশ্যকীয়?
– না।
– আচ্ছা, সাহিত্য দিয়ে সমাজসংস্কার কিভাবে করা যায়?
– জানি না। আমি নিজে সমাজসংস্কারের কথা ভেবে কিছু লিখি না।