দিশার পক্ষ থেকে গত ২১ জানুয়ারির পড়ন্ত বিকেলে গিয়েছিলাম আমি আর বাবু তাঁর আজিমপুরের বাসভবনে। ছিমছাম মধ্যবিত্তের সাজানো-গোছানো ড্রইংরুম। মেঝের উপর জল রং করছেন তাঁর ছোট বোন। স্বাগত জানালেন কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব (হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই)। প্রসন্ন মুখে হুমায়ূন আহমেদ বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন- বলুন ভাই, কী করতে পারি?
বললাম- আপনার ব্যক্তিগত জীবন দিয়েই শুরু করি?
যেহেতু আগেই যোগাযোগ করে আগমনের উদ্দেশ্য নির্ধারিত ছিল।
– আপত্তি নেই।
তিনিই জানালেন, ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর ময়মনসিংহের মোহনগঞ্জে (মামার বাড়ি) তাঁর জন্ম। বাবা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ (স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ), মা আয়েশা আক্তার। তিন ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বড়। পুলিশ অফিসার বাবার সাথে ঘুরে ঘুরে ছোটবেলাতেই অনেক জায়গা ভ্রমণ করেছেন- অর্জন করেছেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা। সিলেটের মীরাবাজারের কিশোরীমোহন পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা সেরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় যথাক্রমে বগুড়া জিলা স্কুল ও ঢাকা কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হন। [তাঁর ছোট ভাই কার্টুনিস্ট আহসান হাবীবের কাছ থেকে জানলাম, মাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি ১৯৬৫ সালে রাজশাহী বোর্ড থেকে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন- এ কথা অবশ্য না লেখার অনুরোধ করেছিলেন।] উচ্চ মাধ্যমিক সেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন রসায়ন বিভাগে। বিজ্ঞান প্রিয় বিষয় বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসসিতে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান (তাঁর ভাইয়ের কাছ থেকে জানা) পাওয়ার পর বেশ কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। এরপর আমেরিকার নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়নে ডক্টরেট করে এসে (১৯৮২ সালে) এখন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত আছেন। জিজ্ঞেস করলাম- বিদেশে থেকে না গিয়ে দেশে ফিরলেন কেন?
– ফিরলাম, যাতে আপনাদের জন্য ‘এই সব দিন রাত্রি’ লিখতে পারি। না ফিরলে কে লিখত?
প্রসঙ্গ পাল্টে লেখালেখি সংক্রান্ত প্রশ্ন শুরু করলাম- লেখালেখির প্রতি অনুরাগ কখন থেকে?
– বানান করে করে প্রথম গল্পটি। যেদিন পড়লাম- মনে হয় সেদিন থেকেই। তবে সুদূরে শৈশবের স্মৃতি মনে নেই। আজকে বলছি।
– প্রথম লেখা কিভাবে ছাপা হলো?
– ‘নন্দিত নরকে’ লেখা খাতাটি বন্ধু আনিস যাবেত ‘মুখপত্র’ পত্রিকার সম্পাদককে দিয়ে এলেন। সেটা ছাপা হলো। প্রথম লেখা ছাপানোর পেছনে কোনো মজার গল্প নেই। এরপর আহমেদ ছফা প্রথম বইটির জন্য প্রকাশক জোগার করলেন। খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানী।
– দ্বিতীয়টা (শঙ্খনীল কারাগার)?
– প্রকাশক চেয়ে নেন।
– ‘নন্দিত নরকে’ আর ‘শঙ্খনীল কারাগারে’ পাত্র-পাত্রীদের নাম একই কেন?
– নতুন নাম খুঁজে পাইনি।
– ঐ দুটোর খোকা চরিত্রের সাথে লেখকের ব্যক্তিজীবনের কী সাদৃশ্য আছে?
– আমি বোধ হয় ওতো ভালো নই। তবে আমিও মাঝে মাঝে খোকার মতো হতে চাই। তা ছাড়া লেখকও খোকার মতো খানিকটা বোকা।
– এ দুটোর প্লট কী করে পেয়েছেন?
– মনে নেই। তবে আমি আগে কখনো প্লট ভেবে লিখতে বসি না।
হুমায়ূন আহমেদ জানালেন, কোনো কিছু লেখার আগে কোনো দিনই তিনি প্লট সাজিয়ে লিখতে বসেন না। লিখতে লিখতেই পাত্র-পাত্রীরা এসে যায়, চরিত্র সৃষ্টি হয়, কাহিনী গড়ায়। লেখার জন্য কোনো রকম পরিবেশ কিংবা ‘মুড’-এর জন্য কোনো ধরনের উপকরণের প্রয়োজন হয় না। চাপের মুখে একটানা সাত-আট ঘণ্টা লেখার অভিজ্ঞতাও তাঁর আছে। তবে সাধারণত অবসর পেলেই লেখেন, আর পড়েন।
– নির্জনে লেখেন না?
– আমার একটা বড় বাড়ি হলে চেষ্টা করে দেখতাম।
– বড় বাড়ির জন্য ইচ্ছা হয় না?
– মাঝে মাঝে হয়।
হুমায়ূন আহমেদের গল্পের পাত্র-পাত্রীরা মধ্যবিত্ত পরিবারের। তাঁর মতে, মধ্যবিত্তদেরকেই তো ভালো করে দেখেছি। সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতায়- এর বাইরে লিখব কিভাবে?
– কেন? উচ্চবিত্ত পরিবারের প্লটেও কিছু কিছু তো লিখলেন- যেমন ‘একা একা’?
কিছু উচ্চবিত্তদেরও দেখেছি।
– গল্প, উপন্যাস ছেড়ে নাটক লিখতে এলেন কখন?
– ১৯৭৪ সনে ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসটিকে মঞ্চনাটকে রূপ দিই। রেডিওর জন্য ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এর বেতার নাট্যরূপ দিই ১৯৭৫-এ। টিভির জন্য প্রথম নাটক লিখি ‘প্রথম প্রহর’ ১৯৮০ সনে।
– কেন এলেন?
– টাকার জন্যে।
এরপর কথা হলো বাংলাদেশ টেলিভিশনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক ‘এই সব দিন রাত্রি’ নিয়ে। জানালেন যে মুস্তাফিজুর রহমান সাহেবের আগ্রহে এ সপ্তাহের একটি নাটককে বড় করে দেয়া হলো। সিরিজ নাটকে। দর্শক হিসেবেও তাঁর কাছে নাটকটি উপভোগ্য ছিল। তবে মাঝে মাঝে মনে হতো যে রকম চেয়েছিলেন, সে রকম হচ্ছে না।
– এরপর সিরিজ নাটক লেখার ইচ্ছা আছে?
– আর্থিক ঝামেলায় পড়লে হয়তো লিখব।
– সিনেমার জন্য কাহিনী লেখার ইচ্ছা আছে?
– যদি কেউ মুক্তিযুদ্ধের উপর ভালো ছবি করতে চায় তাহলে লিখব।
হুমায়ূন আহমেদের একটা বৈশিষ্ট্য (কিংবা দোষ) যে তার বেশির ভাগ কাহিনীতেই বিশেষ কয়েকটি নাম বার বার ঘুরে ঘুরে আসে। অথচ প্রতিটি চরিত্রই স্বতন্ত্র। এটা কেন হয়- জানতে চাইলেই সহজ উত্তর দেন, ‘নতুন নাম খুঁজে পাই না’। আমার বিশ্বাস হতে চায় না। মনে হয় কোনো একটা কিছুকে লুকোনোর জন্যই এগিয়ে যাওয়ার মতো উত্তর। পাশে বসা তাঁর স্ত্রী জানালেন, ‘ও উপন্যাস লিখতে বসে আমাকে নাম জিজ্ঞেস করে। আমি সাথে সাথে বলতে না পারলে বলে- আমি তাহলে আগের নামটিই লিখি? এভাবেই একই নাম বার বার আসে- আসলে অন্য কিছু নয়।’