ইমদাদুল হক মিলন : আপনি যে ঘটনা বললেন, এটি সত্যি মনে রাখার মতোই ঘটনা। আপনি কি অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাসী?
হুমায়ূন আহমেদ : না। পৃথিবী লজিকে চলে। মিরাকল পৃথিবীর চালিকাশক্তি নয়।
ইমদাদুল হক মিলন : কিন্তু আপনি তো প্রায়ই মাজারে যান। সিলেটে গেলেই শাহজালাল সাহেবের মাজার জিয়ারত করেন।
হুমায়ূন আহমেদ : মহাপুরুষদের মাজার জিয়ারত করা মানেই কিন্তু অলৌকিকে বিশ্বাস স্থাপন না। শাহজালাল, শাহ মখদুম, শাহ পরান_এঁরা সবাই উঁচু শ্রেণীর সুফি মানুষ। সব কিছু ছেড়েছুড়ে মানুষের কল্যাণের জন্য এ দেশে এসেছেন। ধর্মীয় কাজকর্মের পরও তাঁরা পুরো জীবন ব্যয় করেছেন সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য। তাঁরা তো মহাপুরুষ পর্যায়ের মানুষ। আমরা যদি অন্য কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির কবরস্থানে যাই তাঁকে সম্মান দেখানোর জন্য_আমরা এঁদের কাছে যাব না কেন? একটু চিন্তা করে দেখো, কোথায় কোন দেশ থেকে কত জায়গা ঘুরে তাঁরা বাংলাদেশে এসেছেন। তাঁদের ত্যাগটা দেখো না! তাঁদের কষ্টটা দেখো না। তা ছাড়া মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি, ইসলামী ভাবধারায় বড় হয়েছি, ছোটবেলা থেকে মা-বাবাকে দেখেছি_তাঁরা নামাজ পড়ছেন, সকালবেলা ঘুম ভেঙেছে আমার মায়ের কোরআন তিলাওয়াত শুনে। এটা তো ব্রেনের মধ্যে ঢুকে যায়।
[সংগ্রহ : আনোয়ার জাহান ঐরি, চলন্তিকা ডট কম।]
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম সাক্ষাৎকার – নিয়েছিলেন শাকুর মজিদ
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন শাকুর মজিদ। সেখান থেকে এটি তুলে ধরা হল।
বিশাল কুশনে আধশোয়া শাকুর মজিদ বললেন, ১৯৮৬ সালে ‘দিশা’ হুমায়ূন আহমেদের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। এটিই পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকার। এখন কিভাবে লেখাটা পাওয়া যায় সেই এতদিনকার কথা। বললাম, তিনটা জায়গায় খুঁজে দেখতে পারেন। এক. ন্যাশনাল আর্কাইভস, দুই. জাতীয় গণগ্রন্থাগার এবং তিন. বাংলা একাডেমী। দেরি না করে ফোন করলাম মোবারক হোসেনকে; বাংলা একাডেমীর গ্রন্থাগারের ভারপ্রাপ্ত। রাত সাড়ে এগারোটা প্রায়। ভয় ছিল, হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। না, ফোনটা ধরল এবং বিষয়টা বললাম। শাকুর এসেছিল আমার উপর তলায় হুমায়ূনের বাসার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের পাশে একদণ্ড থাকতে। ফেরার সময় আমার ঘরে আসা। তো তখনই হুমায়ূন প্রসঙ্গ উঠতে এই তথ্যটা বের হলো। পরদিন মোবারকের ফোন পাই। কণ্ঠস্বরে অস্থিরতা, হ্যাঁ পাওয়া গেছে। শুধু আমি নই, মোবারকও অবাক, এই পত্রিকা একাডেমীর লাইব্রেরিতে আছে! এমন কোনো বিখ্যাত পত্রিকা নয়, বেশি দিন প্রকাশিতও হয়নি, অনেকটা অগোচরেই এসেছে আবার চলেও গেছে। আর পূর্বসূরি কোনো এক লাইব্রেরিয়ান বাঁধাই করে রেখে দিয়েছেন আলমারির তাকে। তিনি কি জানতেন একদিন খোঁজ পড়বে! সাক্ষাৎকারে অপেক্ষা করছে এ সময়ের পাঠকদের জন্য বিস্ময় এবং কালজয়ী তথ্য। সচিত্র পাক্ষিক দিশার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বরে। সম্পাদক শামসুন্নাহার জ্যোৎস্না ১৪৯ সি ধানমণ্ডি, ১৩/২ রোড নং ঢাকা। জানা যায়, এই সচিত্র পাক্ষিক দিশার সর্বমোট ২০টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। হ্যান্ড কম্পোজে ‘সুশ্রী’ টাইপে পদ্মা প্রিন্টার্সে মুদ্রিত। আর হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকারটি মুদ্রিত হয় ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬ সালে প্রথমবর্ষ নবম সংখ্যায়। সাক্ষাৎকারের ভেতরে ভেতরে ছাপা হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের, তাঁর পরিবারের সদস্যদের আলোকচিত্র। তরতাজা মানুষটি ছবি হয়ে গেল- অথচ সাক্ষাৎকারের বিষয় বক্তব্য এখনো অনেকাংশে অটুট। শাকুর মজিদের এই সাক্ষাৎকারের ভেতর পর্যবেক্ষণযোগ্য কিছু তথ্য রয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে হুমায়ূন খুব একটা বদলাননি। সব কথা অকপট, খোলামেলা। এ সময়ের পাঠকদের জন্য রয়েছে কিছু প্রশ্নের উত্তর। তাঁর রচিত চরিত্রের নামকরণের জটিলতা, বিভিন্ন গ্রন্থের নামকরণ প্রসঙ্গ। আর সাক্ষাৎকারের শেষে শাকুর মজিদ লিখেছেন ‘…বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় (বর্তমানে) ঔপন্যাসিক…।’ শাকুর মজিদ এর ‘বর্তমান’ কখনও বদলায়নি। আজও রয়ে গেছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এই ‘বর্তমান’ সব সময়ই বর্তমান থাকবে। এখানেই শেষ নয়। শাকুর মজিদ এরই ফাঁকে হুমায়ূন আহমেদের মায়েরও সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এই অংশটি পড়ে পাঠকের হৃদয় দুমড়ে-মুচড়ে হাহাকার করবে। ‘তাঁর বাবা পাণ্ডুলিপিটা তাঁর হাতে দিয়ে বললেন- এটা যত্ন করে রেখে দিস- তুই একদিন খুব নামকরা লেখক হবি।’ আলমগীর রহমান, স্বত্বাধিকারী প্রতীক ও অবসর প্রকাশনা সংস্থা
হুমায়ুন ফরীদি অভিনীত নাটক ‘নির্বাসন’ দেখতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ নামের একজন লেখকের সাথে যখন আমার প্রথম পরিচয় তখন আমি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র (১৯৮০)। পরে খোঁজ নিয়ে শুনলাম এ লেখকের আরো তিনটে উপন্যাস বেরিয়েছে লেখকশিবির পুরস্কার প্রাপ্ত ‘নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’ আর বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’। সহজলভ্যতার সুবাদে বই তিনটি সাথে সাথে পড়ে নিতে আমার খুব একটা সময়ের প্রয়োজন হয়নি। এরপর ঈদ সংখ্যা কিংবা আর কোনো কাগজে বেশ কিছুদিন তাঁর কোনো লেখা পড়িনি। বন্ধুরা অনেকে বলত যে হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন। নিজেও বিশ্বাস করেছি। এরপর হঠাৎ একদিন টেলিভিশনেই সম্ভবত ‘প্রথম প্রহরে’ শিরোনামে হুমায়ূন আহমেদের একটা নাটক দেখলাম- কিন্তু তখনও সংশয় কাটেনি। সন্দেহ ছিল নন্দিত নরকেরই সেই হুমায়ূন আহমেদ, নাকি অন্য কেউ? এরপর অবশ্য ঈদ সংখ্যাগুলো খুলতেই চোখে পড়ত আমার অনেক দিনের কাঙ্ক্ষিত সেই ঔপন্যাসিকের নাম- দীর্ঘ সাত বছর পলিমার রসায়নে পিএইচডি নিয়েও যিনি নিজেকে আধুনিক বাংলা গদ্য সাহিত্যের এক অভিনব আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন, যেটা কেবল তাঁর একারই। আর প্রকাশকদের অহর্নিশ চাহিদা আর পাঠক-পাঠিকার নিরঙ্কুশ ভালো লাগাই যদি জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হয় তবে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ।