হেডস্যার হতভম্ব। এ দেখি অদ্ভুত চরিত্র!
নিশ্চয় জীবনের এসব অভিজ্ঞতা থেকেই হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস-গল্প-নাটকে অদ্ভুত সব চরিত্রের সমাবেশ ঘটান। তাঁর অভিজ্ঞতা এবং দেখার ভঙ্গি অন্য কারো সঙ্গে মেলে না।
এসব ঘটনা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আড্ডায় হুমায়ূন ভাই মজা করে বলেছেন। আমি আমার স্মৃতি থেকে লিখছি।
হুমায়ূন ভাইয়ের ভয় পাওয়া নিয়ে এবার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি।
১৯৮৫-৮৬ সালের কথা। বিটিভিতে চলছে হুমায়ূন আহমেদের দেশ-কাঁপানো ধারাবাহিক ‘এইসব দিনরাত্রি’। প্রযোজক মুস্তাফিজুর রহমান। সেই নাটক নিয়ে চারদিকে চলছে তুমুল আলোচনা। নাটকের ছোট্ট মেয়ে টুনি, তার ব্লাড ক্যান্সার। দর্শক আতঙ্কে আছে টুনির মৃত্যু নিয়ে। ওই প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনের কোনো ধারাবাহিক নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় পোস্ট এডিটরিয়াল পর্যন্ত লেখা হলো। টুনিকে যেন মেরে ফেলা না হয়। কোনো কোনো সাপ্তাহিক পত্রিকা কাভার স্টোরি করেছে।
নাটক যখন তুঙ্গে, তখন এক সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে হুমায়ূন ভাই গেছেন মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটে। তিনি তখন নিউ মার্কেটের দক্ষিণ দিককার সরকারি কোয়ার্টারে থাকেন। প্রায়ই আমাকে নিয়ে হুমায়ূন ভাই তাঁর ফ্ল্যাটে যান। খাওয়াদাওয়া, গল্প-আড্ডা আর নাটক নিয়ে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা। আড্ডা শেষ করে হুমায়ূন ভাই ফিরে যান তাঁর আজিমপুরের বাসায়, আমি চলে যাই গেণ্ডারিয়ায়।
ও রকম এক সন্ধ্যার ঘটনা।
সিঁড়ি ভেঙে আমরা দুজন মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি। সরকারি পুরনো আমলের ফ্ল্যাট। দরজাগুলো পুরনো। দরজার মাথার ওপর পুরনো আমলের কলিংবেলের সুইচ। সিঁড়িতে টিমটিম করে জ্বলছে অল্প পাওয়ারের একটা বাল্ব। হুমায়ূন ভাই আনমনা ভঙ্গিতে কলিংবেলের সুইচে হাত দিতে গিয়েই ‘উরে বাবা রে’ বলে একলাফে সরে এলেন।
আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। প্রথমে মনে হলো পুরনো কলিংবেল, তারফারে লিকটিক হয়ে আছে কি না! হুমায়ূন ভাই কি ইলেকট্রিক শক খেলেন!
আমি খুবই নার্ভাস ভঙ্গিতে তাঁর হাত ধরলাম। কী হলো, হুমায়ূন ভাই?
তিনি কোনো রকমে বললেন, ‘মাকড়সা।’
_মাকড়সা?
_হ্যাঁ।
তিনি রীতিমতো কাঁপছেন। তাকিয়ে দেখি, কলিংবেলের সুইচের ওখানে মাঝারি সাইজের একটা মাকড়সা।
মাকড়সাকে এ রকম ভয়?
সত্যি তা-ই। হুমায়ূন ভাই সবচেয়ে ভয় পান মাকড়সা। তাঁর ভাইবোনরাও কেউ কেউ মাকড়সাকে খুবই ভয় পান।
সেদিন মাকড়সার ভয়ে মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটে তিনি আর স্বাভাবিকই হতে পারলেন না। দ্রুত আড্ডা শেষ করে আমরা ফিরে এলাম। আমরা তখন প্রায়ই বাংলাবাজারে পাবলিশারদের ওখানে গিয়ে চা-বিস্কুট খাই আর আড্ডা দিই। রয়ালটির টাকা-পয়সার জন্যও যাই কোনো কোনো দিন। আমার অবস্থা তখন খুবই খারাপ। হুমায়ূন ভাই ইউনিভার্সিটির টিচার। তাঁর একটা বাঁধা রোজগার আছে। আমার নেই কিছুই। হুমায়ূন ভাইয়ের কাছ থেকে পঞ্চাশ-এক শ টাকা ধারও নিই। সেই ধার কোনোদিন শোধ করি না। একদিন দুপুরের দিকে বাংলাবাজার থেকে রিকশায় করে যাচ্ছি তাঁর শহীদুল্লাহ হলের কোয়ার্টারে। বাহাদুর শাহ্ পার্কের ওখানে দেখি এক পাখিওয়ালা খাঁচায় করে মুনিয়া পাখি বিক্রি করছে। আমরা রয়ালটির কিছু টাকা পেয়েছি। খাঁচাসহ হুমায়ূন ভাই তিন জোড়া মুনিয়া পাখি কিনে ফেললেন।
ঢাকায় তখন ট্রাফিক জ্যাম বলতে কিচ্ছু নেই। আমরা রিকশায় করে ইউনিভার্সিটি এলাকার দিকে যাচ্ছি। যেতে যেতে দুজনে মিলে একটা বিজনেসের প্ল্যান করে ফেললাম। আমাদের সেই ব্যবসার প্ল্যান ইত্যাদির কথা পরে বলব। এবার আসুন আমাদের দুজনার কথোপকথন বা আমার নেওয়া হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকারের পরের অংশে নিয়ে যাই আপনাদের।
হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার
ইমদাদুল হক মিলন : মানে, আপনার হাতে লেখা কপিটাই পড়েছেন?
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ।
ইমদাদুল হক মিলন : পড়ে কী বললেন?
হুমায়ূন আহমেদ : আমাকে কিছু বললেন না। বাবার সঙ্গে আমাদের ভাইবোনদের দূরত্ব ছিল। বাবা সরাসরি আমাদের কিছু বলতেন না। ভায়া মিডিয়া কথা বলতেন। তাঁর যা বলার তিনি মাকে বলতেন, মা আমাদের বলতেন।
ইমদাদুল হক মিলন : তিনি আপনার মাকে কী বললেন?
হুমায়ূন আহমেদ : পৃথিবীর সব বাবাই সন্তানদের সামান্য প্রতিভায়ই মুগ্ধ হন। তিনিও হয়েছিলেন। তাঁর মুগ্ধতা যে উঁচু পর্যায়ে ছিল, তার প্রমাণ পেলাম কিছুদিন পর। তিনি তখন একটা রেডিও নাটক লিখে শেষ করেছেন। নাম ‘কত তারা আকাশে’। হঠাৎ সেই নাটকের পাণ্ডুলিপি আমার হাতে দিয়ে বললেন, তুই তোর মতো করে ঠিকঠাক করে দে।
আমি আমার একজীবনে অনেক সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছি_ওই দিনের সাহিত্য পুরস্কার সব পুরস্কারের ওপরে।
মিলন, আজ আর না। অনেক বকবক করেছি।
ইমদাদুল হক মিলন : ঠিক আছে, আজ এ পর্যন্তই।
সেদিনের মতো আমরা থেমে গেলাম। তারপর একে একে বন্ধুরা এলেন, আলমগির রহমান, আর্কিটেক্ট করিম, অন্যদিন গ্রুপের প্রধান মাজহারুল ইসলাম, মাসুম রহমান, কমল_শুরু হয়ে গেল আমাদের আড্ডা। প্রিয় পাঠক, ঘটনা ২০০৬ সালের, অন্যদিন পত্রিকার জন্য হুমায়ূন ভাইয়ের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম আমি। এই সেই সাক্ষাৎকার, যা কয়েক পর্বে ছাপা হয়েছিল অন্যদিনে। এবার আমার নিজের স্মৃতিচারণাসহ সেই সাক্ষাৎকার নতুন আঙ্গিকে শিলালিপিতে ছাপা হচ্ছে। কয়েক দিন পর আরেক সন্ধ্যায় আমি তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে বসলাম।