ইমদাদুল হক মিলন : আপনার চাকরিজীবনের কথা বলুন। প্রথমেই কি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করলেন?
হুমায়ূন আহমেদ : না। প্রথমে জয়েন করলাম ময়মনসিংহের অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে মাস চার-পাঁচ মাস্টারি করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিই।
ইমদাদুল হক মিলন : ময়মনসিংহের সময়টা আপনার কেমন কেটেছে?
হুমায়ূন আহমেদ : খুব খারাপ। যদিও ময়মনসিংহ আমার নিজের জেলা। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে একটি বাসা ভাড়া করে থাকতাম। মনে হতো নির্বাসনে এসেছি। সহকর্মীদের কারো সঙ্গই পছন্দ হতো না। তাঁদের চিন্তাভাবনা স্থূল মনে হতো। তাঁদের দেখে মনে হতো তাঁদের জীবন ক্লাস নেওয়া এবং ক্লাস থেকে ফিরে দুপুরে খেয়ে ঘুমানোর মধ্যেই আটকে গেছে।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার সময় কাটত কিভাবে?
হুমায়ূন আহমেদ : ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে হাঁটাহাঁটি করে। রাতে লিখতাম। ‘অচিনপুর’ নামের উপন্যাসটি ময়মনসিংহে লেখা শুরু করি।
ইমদাদুল হক মিলন : তার আগেই তো আপনার ‘নন্দিত নরকে’ ও ‘শঙ্খনীল কারাগার’ প্রকাশিত হয়ে গেছে।
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ।
ইমদাদুল হক মিলন : আচ্ছা, এই যে ‘নন্দিত নরকে’ লেখা হলো একেবারে হঠাৎ করে। তার আগে ‘নন্দিত নরকে’তে একটা ভূমিকা ছিল, সোমেন চন্দরের একটা গল্প ‘ইঁদুর’ আপনাকে প্রভাবিত করেছিল_কিন্তু কথা সেটা না, কথা হলো ছেলেবেলায় পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বই পড়ার অভ্যাসটা আপনার কিভাবে হলো?
হুমায়ূন আহমেদ : ভূমিকাটা ছিল ‘শঙ্খনীল কারাগারে’। আর বই পড়ার অভ্যাসের কথা বলছ? এই অভ্যাস পেয়েছি বাবার কাছ থেকে। তাঁর খুব পড়ার শখ ছিল। বাড়ি ভর্তি ছিল বইয়ে। তিনি লেখালেখিও করতেন। তাঁর একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। নাম ‘দীপ নেভা যার ঘরে’। তাঁর লেখা কলকাতার কিছু পত্রিকা, এ দেশের ‘দৈনিক আজাদ’-এ ছাপা হতো। লেখালেখি করে কলকাতার কোনো এক প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি ‘সাহিত্য সুধাকর’ উপাধিও পেয়েছেন। সেই সময়ের লেখকরা নানা উপাধি পেতেন।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার ‘নন্দিত নরকে’ লেখা কি একেবারেই আচমকা? এর আগে আপনি কি কিছু লিখেছেন কখনো?
হুমায়ূন আহমেদ : কবিতা লিখেছি। ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। তবে নিজের নামে লিখিনি। কবিতাগুলো আমার ছোট বোন মমতাজ আহমেদ শিখুর নামে পাঠাতাম। তার নামেই ছাপা হতো।
ইমদাদুল হক মিলন : ছোট বোনের নামে পাঠাতেন কেন? নিজের নামে নয় কেন?
হুমায়ূন আহমেদ : কবিতাগুলো তেমন সুবিধার ছিল না। পুরুষ কবির কবিতা হিসেবে চলে না। মহিলা কবির কবিতা হিসেবে চলতে পারে।
ইমদাদুল হক মিলন : মহিলাদের সৃষ্টিশীলতাকে আপনি কি ছোট করে দেখছেন না?
হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, তুমি বাংলা ভাষার দশজন মহিলা কবির নাম বলো, যাঁরা পুরুষদের পাশে দাঁড়াতে পারেন।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার ছোট বোনের নামে প্রথম যে কবিতাটি ছাপা হয় তার নাম কী?
হুমায়ূন আহমেদ : দিতে পার একশ ফানুস এনে/আজন্ম সলজ্জ সাধ, একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই।
ইমদাদুল হক মিলন : এটা তো মুক্তিযুদ্ধের আগে?
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধের আগে।
ইমদাদুল হক মিলন : তার পরে এভাবে ক’টা কবিতা পত্রিকায় ছাপানো হয়েছিল, আপনার মনে আছে?
হুমায়ূন আহমেদ : পাঁচটি কবিতা।
ইমদাদুল হক মিলন : তারপর আপনি উপন্যাস লিখলেন?
হুমায়ূন আহমেদ : নাহ্, উপন্যাসটা অনেক পরে…।
ইমদাদুল হক মিলন : উপন্যাসে আসার ঘটনাগুলো বলেন_এই ধরেন_কিভাবে শুরু, কিভাবে আইডিয়াটা এল মাথায়…
হুমায়ূন আহমেদ : প্রথমে তো আমি লিখলাম ‘শঙ্খনীল কারাগার’। যদিও প্রথমে এটা ছাপা হয়নি, কিন্তু উপন্যাস প্রথমে লেখা হয়েছিল ‘শৃঙ্খনীল কারাগার’। কিছুই করার ছিল না সেই সময়। আমার ঠিকমতো মনেও নেই। তবে এই উপন্যাসটা আমার বাবা পড়েছেন_এটা আমার জন্য খুবই আনন্দের একটা ঘটনা।
হুমায়ূন আহমেদের ভালো ছাত্র হয়ে ওঠার গল্পটা বলি।
গল্প না, ঘটনা। গল্পে কল্পনা থাকে, ঘটনায় থাকে সত্যতা। ছেলেবেলায় পড়াশোনায় খুবই খারাপ ছিলেন তিনি। আসলে পড়াশোনায় তাঁর মন বসত না। একেবারেই মনোযোগী ছিলেন না লেখাপড়ায়। স্কুলের পরীক্ষাগুলোয় টেনেটুনে, কায়ক্লেশে পাসটা করতেন। বাবার বদলির চাকরি। একেকবার একেক জেলায়। চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ছেন। সে বছর পাসই করতে পারলেন না। ডাহা ফেল। ফেল করা মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরবেন কী করে! ক্লাস টিচার বড়ুয়া স্যার। তাঁর কাছে গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করলেন। ছাত্রের কান্না দেখে বড়ুয়া স্যারের হৃদয় দ্রবীভূত হলো। তিনি বিশেষ বিবেচনায় ক্লাস সেভেনে তুলে দিলেন। ওপরের ক্লাসে উঠে যেই কে সেই! অবস্থা আগের মতোই। পড়ায় মন বসে না।
মন বসল ক্লাস এইটে ওঠার পর।
স্কুল থেকে তখন খুবই সুস্বাদু, ভালো টিফিন দেওয়া হতো। সেই টিফিনের জন্য ব্যাপক লোভ ছিল বালক হুমায়ূন আহমেদের। এখানে ব্র্যাকেটে আরেকটা কথা বলে রাখি। হুমায়ূন আহমেদের ডাকনাম ‘বাচ্চু’। কবি শামসুর রাহমানেরও ডাকনাম ছিল ‘বাচ্চু’। পরে দুজনের কেউ এই নাম কখনো ব্যবহার করেননি। কাউকে বলতেনও না।
যা হোক, ক্লাস এইটে বৃত্তি পরীক্ষা হবে। ক্লাসের ভালো ছাত্রদের সিলেক্ট করা হয়েছে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য। যারা সিলেক্ট হয়েছে, স্কুলে তাদের মহাসমাদর। স্যাররা খাতির করছেন, ছাত্ররা খাতির করছে। তাদের যত্ন-আত্তির অভাব নেই। যেহেতু বৃত্তি পরীক্ষা দিতে হবে, সেহেতু ফাইনাল পরীক্ষাও তাদের দিতে হবে না। আর যেটা সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা সেটা হলো, ভালো ছাত্রদের টিফিন দেওয়া হবে ডাবল। সাধারণ ছাত্ররা যে টিফিন পাবে, ওরা পাবে তার দ্বিগুণ।