ইমদাদুল হক মিলন : বাংলা ভাষার খুব জনপ্রিয় লেখক হচ্ছেন শরৎচন্দ্র, তারপর তারাশঙ্কর। কিন্তু যে অর্থে জনপ্রিয়তাকে আমাদের দেশে বিবেচনা করা হয়, এঁরা সেই স্তরের লেখক না এবং আমরা সেই সারিতে আপনাকে অনেক আগেই যুক্ত করেছি। আপনার কি মনে হয়?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার কিছু মনে হয় না, মিলন। আমি এটা আগেও বলেছি। তবে শোনো, আমাদের দেশের লেখকদের ভাগ্য খুবই খারাপ। শুধু লেখালেখি করে আমাদের লেখকরা জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন না। সেখানে আমার যে অবস্থানটা হয়েছে, মাঝেমধ্যে আমার কাছে খুবই বিস্ময়কর মনে হয়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন অধ্যাপনা করি, মাসে ছয় হাজার-সাড়ে ছয় হাজার টাকা পাই, থাকি শহীদুল্লাহ হলে। হঠাৎ করে দেখলাম, লোকজন আমার বই পড়া শুরু করেছে। আমি কী করলাম? মাথা খারাপ থাকলে যা হয় আর কি! সব কিছু বাদ দিয়ে একটা গাড়ি কিনে ফেললাম।
ইমদাদুল হক মিলন : কিনলেন কি, ওটা তো ছিল একটা গিফট। ওটা আপনাকে উপহার দিয়ে গেল এক প্রকাশক। এ ধরনের ঘটনা বাংলা সাহিত্যে কোনো লেখকের ক্ষেত্রে কখনো ঘটেনি।
হুমায়ূন আহমেদ : এটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা ছিল। কিন্তু ইন্টারেস্টিং ঘটনার এখানেই শেষ না। আট মাসের মাথায় আরো বেশি টাকা হয়ে গেল। আমি কিনে ফেললাম মাইক্রোবাস। আমার মাইক্রোবাসের তো তখন দরকার নেই। কেন কিনলাম? এটার কোনো লজিক্যাল কারণ থাকতে পারে? কোনো কারণ নেই, কিন্তু আমার গাড়ি রাখার জায়গা নেই। হলের ভেতরও তো জায়গা নেই। একটা ছোট গাড়ি, আবার একটা মাইক্রোবাস বাসার সামনে পড়ে থাকে। আমার দেখতে খুবই ভালো লাগে। মাঝেমধ্যে মাইক্রোবাসের দরজা খুলে রাতে মাইক্রোবাসে চুপচাপ গিয়ে বসা। এর চেয়ে হাস্যকর কিছু হতে পারে? একজন লেখকের পক্ষেই এ রকম হাস্যকর জিনিস করা সম্ভব। একজন লেখকের চারটি গাড়ি। একটা পর্যায়ে আমার গাড়ি ছিল চারটি। চারটি গাড়ির দরকার নেই আমার। কিন্তু ড্রাইভার আমার একটি। একটি লোক যে চারটি গাড়ি কিনবে তাঁর চারটি ড্রাইভার থাকবে বা তিনটি ড্রাইভার থাকবে। চারটি গাড়ি নিয়ে আমি বসে আছি, আমার ড্রাইভার কিন্তু একজন। চারটি গাড়ি কেন কিনলাম? এগুলো করার সুযোগ করে দিয়েছে আমার বইগুলো। আমার নানা ধরনের পাগলামি পূরণ করতে পারছি কী জন্য? মানুষজন আমার বই পড়ছে বলে। এই যে আমি সেন্ট মার্টিনে একটি বাড়ি কিনে রেখেছি, কেন? নুহাশপল্লী বানিয়ে রেখেছি, কেন?
ইমদাদুল হক মিলন : তার মানে, আপনার মনে হয় আপনার মধ্যে পাগলামি আছে?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার মধ্যে পাগলামি আছে।
ইমদাদুল হক মিলন : এটা কি আপনার বাবার মধ্যেও ছিল? আমি যত দূর জানি, আপনার বাবা, আপনি ‘আমার ছেলেবেলা’ বইয়ে লিখেছিলেন যে তিনি এক মাসের বেতন পেয়ে একটি ঘোড়া কিনে নিয়ে এসেছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদ : ঘোড়া কিনে এনেছিলেন, বেহালা কিনে এনেছিলেন।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার বাবার ঘোড়া কেনার সঙ্গে আপনার মাইক্রো কেনার কোনো যোগসূত্র আছে?
হুমায়ূন আহমেদ : ভালোই তো মিলিয়েছ। শুধু ঘোড়া না, বাবা তাঁর বেতনের টাকায় বেহালাও কিনেছিলেন। সেই সময় উনি বেতন পেতেন আশি টাকা। বেহালাটা কিনেছিলেন পঁচিশ টাকা দিয়ে। ওটা কেনা মানে ওই সময় বেতনের অনেকটাই চলে যাওয়া। খুবই দামি একটি বেহালা। এই বেহালাটা তিনি ওপরে উঠিয়ে রেখে দিলেন। আমাদের নাগালের বাইরে রেখে দিলেন। কী জন্য বেহালাটা কিনলেন? কোনো একসময় তিনি একজন ওস্তাদ পাবেন বেহালার, তখন তিনি শিখবেন। তাই আগে থেকে কিনে বসে আছেন। সেই ওস্তাদও পাওয়া গেল না। হয়তো বা পাওয়া গেল, শেখার পয়সাটা জোগাড় করতে পারলেন না। তাঁর বেহালা শেখা হলো না। একটা পর্যায়ে বেহালাটা তাকের ওপর থেকে নামিয়ে আমরা ভাইবোনরা কিছুক্ষণ পোঁ পোঁ করে বাজাতাম, তারপর উঠিয়ে রাখতাম, বাবা যাতে টের না পান।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার লেখালেখির মধ্যে পাঠকরা একধরনের পাগলামির প্রকাশ দেখতে পায়, এর কারণটা কী?
হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, তুমি এখন আমাকে দিয়ে বলানোর চেষ্টা করছ যে আমি পাগল। পাগল বলেই লেখায় পাগলামি উঠে আসে। আচ্ছা, যাও আমি পাগল। কি, তুমি খুশি তো? আর বকবক করবে না। স্টপ।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনি বললে স্টপ।
(ইন্টারভিউ বন্ধ হলো। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর তোলা ফটোগ্রাফের স্তূপ নিয়ে বসলেন। একেকটা ছবি হাতে নিচ্ছেন এবং ব্যাখ্যা করছেন। আমি বললাম, আপনার ছবির চেয়ে ব্যাখ্যা সুন্দর। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, যাও, তোমাকে আর ছবি দেখাব না।)
ইমদাদুল হক মিলন : লেখাপড়ার প্রসঙ্গে আসি। আপনি একবার বলেছিলেন আপনি লেখাপড়ায় মনোযোগী ছিলেন না।
হুমায়ূন আহমেদ : না, ছিলাম না। ছোটবেলায় একেবারেই ছিলাম না। পড়াশোনায় আমার মন বসে অনেক পরে। স্কুলের সব পরীক্ষায় টেনেটুনে পাস করতাম। ক্লাস সিঙ্ ে(চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুল) ফেল করি। আমাদের ক্লাস টিচার বড়ুয়া স্যার আমার কান্নায় দ্রবীভূত হয়ে বিশেষ বিবেচনায় পাস করিয়ে দেন।
ইমদাদুল হক মিলন : পড়াশোনায় আপনার মন বসল কখন?
হুমায়ূন আহমেদ : তখন ক্লাস এইটে পড়ি। বৃত্তি পরীক্ষা হবে। ভালো ছাত্ররা বৃত্তি পরীক্ষার জন্য সিলেক্ট হয়েছে। তাদের বিশেষ যত্ন। ডাবল টিফিন পায়। যেহেতু বৃত্তি দিচ্ছে, তাদের ফাইনাল পরীক্ষাও দিতে হবে না। আমার খুব… [এখানে মজার একটা ঘটনা আছে, হুমায়ূন ভাইয়ের জবানিতে না, আমার মতো করে আমি ঘটনাটা লিখব]