অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম একরাতে।
কোথাও বেশ একটা জনকোলাহল। অনেক সুন্দরী নারী। সম্ভবত কোথাও কোনো সাহিত্য সম্মেলন হচ্ছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখতে পেলাম আসরের মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন। গান-গল্পে মুখর হয়ে আছে অনুষ্ঠান।
একসময় সুনীল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমাকে এক্ষুনি ছুটতে হবে। প্লেন ধরতে হবে।’
তিনি কিছুক্ষণের জন্য উধাও হয়ে গেলেন। তারপর পোশাক বদলে একটা ব্যাগ হাতে বেরিয়ে এলেন। ব্যাগটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার পেছন পেছন এসো।’
আমি সুনীলের পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করলাম।
একটা সময় দেখি কিছুতেই আমি আর তাঁর নাগাল পাচ্ছি না। তিনি আমাকে অনেকটা পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছেন। হাঁটা বাদ দিয়ে তাঁকে ধরার জন্য আমি ছুটছি। সামনে একটা জলাশয়। সুনীলকে দেখি জলাশয়ের ওপারে। একবারও পেছন ফিরে তাকাচ্ছেন না, মাঝারি মানের মোটা শরীর নিয়ে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছেন। আমি জলাশয় পেরিয়ে তাঁকে ধরার চেষ্টা করছি, পারছিই না।
এটুকুই স্বপ্ন। কী অর্থ ওই স্বপ্নের কে জানে। তবে সুনীলদা আমাকে ফেলে নিউ ইয়র্কের লাগোর্ডিয়া বিমানবন্দর থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসে চলে গিয়েছিলেন। সেবার হুমায়ূন ভাইও ছিলেন। নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের ‘মুক্তধারা’ বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান। মুক্তধারার কর্ণধার বিশ্বজিৎ সাহা বইমেলার আয়োজন করেছিলেন। বাংলাদেশ থেকে অতিথি হিসেবে গিয়েছিলাম হুমায়ূন আহমেদ আর আমি। কলকাতা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সমরেশ মজুমদার। হুমায়ূন ভাই দল ছাড়া চলতে পারেন না। অন্যদিন গ্রুপের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম আছেন আমাদের সঙ্গে, হুমায়ূন ভাইয়ের অতিপ্রিয় বন্ধু আর্কিটেক্ট আবু করিম আছেন। অন্যদিন গ্রুপের কমলও ছিলেন।
এই ঘটনা বলার আগে একটু পেছন ফিরি। হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে বলি।
হুমায়ূন আহমেদ কোনো কিছু লুকাতে জানেন না, আড়াল করতে জানেন না। তিনি তাস খেলেন মাটিতে ফেলে। সবাই দেখতে পায় তাঁর হাতের তাস। সম্পূর্ণ নিজের মতো একটি জীবন তিনি যাপন করেন। যা ভালো লাগে, বিশ্বাস করেন, তা-ই করেন। কোনো কাজ করার আগে বন্ধুদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ-আলোচনা করেন, প্রত্যেকের মতামত নেন; কিন্তু করেন সেটাই, নিজে যেটা ভালো মনে করেন। সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে বেড়াতে গিয়ে ভাবলেন, এ রকম দ্বীপে একটা বাংলোবাড়ি করলে কেমন হয়? জায়গা কিনে বাড়ি করে ফেললেন। তাঁর সেই বাড়ি ইতিহাস হয়ে গেল। দেশের সব মানুষ জানে। বাবা ফয়েজুর রহমান আহমেদ একাত্তরের বীর শহীদ, বাংলাদেশ সরকার তাঁর নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে আর হুমায়ূন আহমেদ তাঁর পিতার স্মরণে ৭০ লাখ টাকা ব্যয় করে নিজ গ্রামে একটা স্কুল করেছেন। সেই স্কুলের ডিজাইন ও পরিবেশ স্কটল্যান্ডের মতো। তাঁর নুহাশপল্লী এখন আপন মহিমায় বিখ্যাত। বহু লোক দেখতে যায়। ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে হোতাপাড়ার পশ্চিমে ঢুকে গেছে যে সড়ক, সেই সড়কের নাম ‘নুহাশপল্লী সড়ক’। মোটকথা, হুমায়ূন আহমেদ যা করেছেন, তা-ই ইতিহাস হয়ে গেছে। জীবনে যা চেয়েছেন তিনি, পেয়েছেন তার চেয়ে বহুগুণ বেশি।
শাহাদৎ চৌধুরী সম্পাদিত একসময়কার বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ই তাঁকে নিয়ে পাঁচ-ছয়বার কাভার স্টোরি করেছে, ‘রোববার’, ‘পূর্ণিমা’, ‘অন্যদিন’ তো করেছেই, আরো কত পত্রিকা যে করেছে! তাঁর একক বইমেলা হয়েছে বাংলাদেশের বহু জায়গায়, নিউ ইয়র্কে, ফ্রাংকফুর্টে। নিজের তৈরি ছবির ফেস্টিভ্যাল হয়েছে জাপানে। জাপানের বিখ্যাত টেলিভিশন এনএসকে তাঁকে নিয়ে ১৭ মিনিটের ডকুমেন্টারি করেছে_’হু ইজ হু ইন এশিয়া’। শাহরিয়ার কবির, অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ তাঁকে নিয়ে বই লিখেছেন। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে বাকের ভাইয়ের যাতে ফাঁসি না হয়, সে জন্য মিছিল বেরিয়েছে ঢাকার রাস্তায়, পোস্টারিং হয়েছে। আসাদুজ্জামান নূরের মতো জনপ্রিয় অভিনেতা, এখন আওয়ামী লীগের বিখ্যাত নেতা এবং সংসদ সদস্য চাপা পড়ে গেছেন বাকের ভাইয়ের আড়ালে। এখনো লোকে তাঁকে বাকের ভাই বলেই চেনে। নাটকটির শেষ পর্ব যেদিন প্রচারিত হয়, সেদিন হুমায়ূন ভাই বাড়িতে থাকতে পারেননি। বাকেরের যাতে ফাঁসি না হয়, সে জন্য হাজার হাজার লোক এসে দাঁড়িয়েছিল তাঁর বাড়ির সামনে।
যেখানে হাত দিয়েছেন হুমায়ূন ভাই, সোনা ফলেছে। ব্যর্থতা বলে কোনো জিনিস হুমায়ূন আহমেদের ধারেকাছেও ভিড়তে পারেনি কখনো। টিভি নাটক লিখতে এসে সম্পূর্ণ নতুন এবং নিজস্ব একটি ধারা তৈরি করে দিলেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদের নাটক শুধুই হুমায়ূন আহমেদের নাটক, অন্য কারো সঙ্গে মেলে না, অন্য কেউ তাঁর মতো লিখতেও পারেন না। ‘এইসব দিনরাত্রি’ থেকে শুরু হলো। ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’_আরো কত তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয় নাটক!
সিনেমা করলেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণী আবার হলে ফিরল। প্রথম ছবিতেই আট-দশটি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড। অসাধারণ কিছু গান লিখলেন, যেমন_’এক যে ছিল সোনার কন্যা মেঘবরণ কেশ, ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ’। দুর্দান্ত কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি করলেন, যেমন_হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো কুদ্দুস বয়াতির পেছনে ৪০-৫০টি শিশু ছুটছে। প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের বিজ্ঞাপন। তাঁর প্রায় প্রতিটি ধারাবাহিকের জনপ্রিয় চরিত্রদের নিয়ে বিজ্ঞাপন হয়েছে। একটি নাটকে রাধারমণের গান ব্যবহার করলেন, ‘আইজ পাশা খেলব রে শ্যাম’। গানটি জনপ্রিয়তায় রেকর্ড করল। সিনেমা-নাটকে ব্যবহার করে হাছন রাজার গানকে নতুন করে জনপ্রিয় করালেন তিনি। তাঁর গল্প পড়ে রমাপদ চৌধুরী বলেন, বিশ্বের যেকোনো ভাষার ভালো গল্পগুলোর সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের গল্প তুলনীয়। তিনিই একমাত্র বাঙালি লেখক, যিনি সাত বছর ধরে ‘দেশ’ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় উপন্যাস লিখেছেন। এই সৌভাগ্য আর কোনো বাঙালি লেখকের হয়নি।