ইমদাদুল হক মিলন : ঘুরে ফিরে ‘লীলাবতী’র প্রসঙ্গটায় আবার আসি। আপনার এ লেখাটা এমন আচ্ছন্ন করেছে আমাকে, এর আগে ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ পড়ে এমন আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। লীলাবতীতে মাসুদ নামের একটি ছেলে গোপনে এক সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছে, পরীবানু যার নাম, আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই। সে চরিত্রটা আবার আত্মহত্যা করল। আপনি মানুষকে এত নির্মমভাবে মেরে ফেলেন কেন আপনার লেখায়?
হুমায়ূন আহমেদ : আমাদের জগৎটা কিন্তু খুব নির্মম। এ জগতে মানুষ যখন মরে যায়, খুব স্বাভাবিকভাবেই সে মরে যায়। সৃষ্টিকর্তাও কিন্তু নির্মম। এই যে সুনামিতে দেড় লক্ষ দুই লক্ষ লোক মারা গেল, তিনি নির্মম বলেই তো এত লোক মারা গেল। এই নির্মমতাটা কিন্তু আমাদের মধ্যেও আছে। কথা নেই বার্তা নেই একজন গলায় দড়ি দিচ্ছে, হঠাৎ করে একজন ঘুমের বড়ি খেয়ে নিচ্ছে। যে ঘুমের বড়িটা খাচ্ছে, সে কিন্তু খুব আয়োজন করে খাচ্ছে তা না। মনে হলো খেয়ে নিল। জীবনানন্দের সেই বিখ্যাত কবিতা, ‘শোনা গেল লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে/ কাল রাতে_ফাল্গুনের রাতের আঁধারে/ যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/ মরিবার হলো তার সাধ/…বধূ শুয়ে ছিল পাশে_শিশুটিও ছিল/প্রেম ছিল, আশা ছিল/ জ্যোৎস্নায়,_তবু সে দেখিল কোন ভূত/ ঘুম ভেঙে গেল তার? অথবা হয়নি তো ঘুম বহুকাল/ লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার/ এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি/ রক্তফেনা-মাখা মুখে/ মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি/ আঁধার গুজির বুকে ঘুমায় এবার;/ কোনোদিন জাগিবে না আর/ কোনোদিন জাগিবে না আর/ জাগিবার গাঢ় বেদনার/ অবিরাম_অবিরাম ভার/ সহিবে না আর।’ [এই পর্যায়ে আমি জীবনানন্দ দাশের দীর্ঘ কবিতার প্রায় সবটাই চোখ বন্ধ করে আবৃত্তি করলাম। কারণ? আশপাশে সবাইকে জানান দেওয়া যে, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কবিতা মুখস্থ বলতে পারি। মিলনকে সামান্য ভড়কে দেওয়ার ইচ্ছাও যে ছিল না, তা না।]
ইমদাদুল হক মিলন : এই ‘লীলাবতী’ উপন্যাসটা আপনি জীবনানন্দকে উৎসর্গ করেছেন। উৎসর্গের ভাষাটা হচ্ছে এ রকম_তিনি জীবিত, আপনি কবির উদ্দেশে বলছেন_কবি, আমি কখনো গদ্যকার হতে চাইনি। আমি আপনার মতো একজন হতে চেয়েছি। হায়, এত প্রতিভা আমাকে দেওয়া হয়নি।
হুমায়ূন আহমেদ : জীবনানন্দ দাশের কবিতা যখন পড়ি, তখন মনে হয় কবি যেন পাশেই আছেন। আমি যখন গভীর আগ্রহ নিয়ে তাঁর কবিতাটি পাঠ করছি তিনি সেটা শুনতে পাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও আমার এই ব্যাপারটি ঘটে। যখন রবীন্দ্রসাহিত্য পড়ি, তখন মনে হয়, তিনি বুঝি আশপাশেই আছেন। অল্প কিছুদিন আগে বিভূতিভূষণের ‘কিন্নরদল’ গল্পটি পড়ছিলাম…
ইমদাদুল হক মিলন : হ্যাঁ, এটা আপনার খুব প্রিয় একটা গল্প…
হুমায়ূন আহমেদ : আমি যখন গল্পটি পড়ছি, তখন আমার মনে হলো, তিনি আমার পাশেই আছেন। গল্পটি পড়ে আমি আনন্দ পাচ্ছি এবং সেই আনন্দটা তিনি বুঝতে পারছেন। এটা আমার ছেলেমানুষি হতে পারে। কিন্তু এই অনুভূতিটা আমার প্রায়ই হয়। যেকোনো ভালো লেখা পড়ার সময়ই আমার মনে হয় লেখক আমার পাশে আছেন।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার লেখা পড়তে পড়তে আমার মনে হয়, ধরেন আপনি লিখছেন, কিন্তু এর পরে কোন লাইনটা লিখবেন আপনি জানেন না?
হুমায়ূন আহমেদ : কিছু কিছু লেখক আছেন, যাঁরা প্রতিটি লাইন খুবই চিন্তাভাবনা করে লেখেন। আবার একধরনের লেখক আছেন, স্বতঃস্ফূর্ত লেখক। মাথায় যেটা আসবে সেটা লিখবে। আমার লেখার ওপর খুব একটা কন্ট্রোল আছে_তা না, কন্ট্রোল আছে হালকা, আমার মনে হয় যে আমার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে লেখাটা বেশি কাজ করে। কিন্তু আমি যখন ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ লিখেছি তখন কোন লাইনের পর কোন লাইন লিখব আমি জানি। আমি যখন মিসির আলী লিখি তখন কিন্তু আমি জানি এই লাইনটার পরে আমি কোন লাইন লিখব। সায়েন্স ফিকশন লেখার সময় আমি জানি কোন লাইনটা লিখব। ওই বাকি লেখাগুলোর সময় আমার আর কন্ট্রোল থাকে না।
ইমদাদুল হক মিলন : ‘লীলাবতী’ লেখার সময় জানতেন?
হুমায়ূন আহমেদ : না।
ইমদাদুল হক মিলন : ‘লীলাবতী’র একটা ছোট চরিত্রের কথা বলি, চঞ্চলী, সে রমিলার বোন। রমিলা মাঝে মাঝে বলে আমি পানিতে ডুবে গেলাম। আমার বোন আমার জন্য ঝাঁপ দিল, আমি উঠে গেলাম কিন্তু সে আর উঠল না। সে এখন সব সময় আমার সঙ্গে থাকে। মাগো, এই জন্য আমি তোমার সঙ্গে ঢাকায় যাব না। এই যে চরিত্রটা, আপনি জেনেই লিখেছেন নাকি হঠাৎ?
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ হঠাৎ…হঠাৎ করেই মাথায় এসেছে, আবার হঠাৎ করেই চলে গেছে। চলে গেছে যখন এটা নিয়ে পরে আর মাথা ঘামাইনি। যেমন দীঘির জলে একটা মাছের লেজ ভেসে উঠল। জলে ঘাই দিয়ে তলিয়ে গেল।
ইমদাদুল হক মিলন : এটি ১৩৫৭ সালের পটভূমিতে লেখা উপন্যাস, এখানে আনিস চরিত্রটা কতটুকু যৌক্তিক বলে মনে হয়েছে?
[বুঝতে পারছি মিলন এখন প্রমাণ করার চেষ্টা করবে যে, আনিস চরিত্রটি যৌক্তিক না। আমাকে এই মুহূর্তে কঠিন অবস্থানে যেতে হবে। দেরি করা যাবে না।]
হুমায়ূন আহমেদ : (কঠিন গলা) মিলন যথেষ্ট হয়েছে। রেকর্ডার বন্ধ কর। চা খাও। আজকের মতো এখানেই ইতি।
[মিলন রেকর্ডার বন্ধ করল। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। হাত বাড়িয়ে আমার ডান হাত শক্ত করে চেপে ধরল। অনেক দিন আগের একটি স্মৃতি আমার মনে পড়ল। তখন শ্যামলীর এক ভাড়া বাড়িতে থাকি। আমার হয়েছে ভয়াবহ জন্ডিস। মিলন প্রচুর ফলমূল নিয়ে আমাকে দেখতে এসেছে। তার মাথাটা পরিষ্কার করে কামানো। তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সে আমার বিছানার পাশে বসল। শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরল। মুখে কিছুই বলল না। এভাবে সে বসে থাকল দীর্ঘ সময়। ভাব প্রকাশের ব্যাপারটা লেখকদের চেয়ে ভালো কেউ জানেন না। কিন্তু গভীর আবেগের সময় যে তারা কিছুই বলেন না_এই তথ্য কি সবাই জানে?