ইমদাদুল হক মিলন : আপনার সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘লীলাবতী’ দিয়েই শুরু করছি। এটা পড়ে মনে হয়েছে, প্রধান চরিত্র হচ্ছে সিদ্দিকুর রহমান। এই উপন্যাসটির নাম ‘সিদ্দিকুর রহমান’ বা ‘সিদ্দিকুর রহমানের জীবন’ এ রকম হতে পারত। ‘অনিল বাগচীর একদিন’ নামে আপনার একটা বই আছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের নামেই যদি নামকরণ করেন, তাহলে উপন্যাসটির নাম ‘লীলাবতী’ কেন?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি তো মনে করি যে, ‘লীলাবতী’ উপন্যাসে যে কটি চরিত্র এসেছে, প্রতিটিই প্রধান চরিত্র।
[ভুল উত্তর। উপন্যাসের সব চরিত্রই প্রধান হতে পারে না। ঔপন্যাসিক মিলন অবশ্যই এটা জানে। কিন্তু সে এমন ভাব করল যেন সে আমার উত্তর গ্রহণ করেছে। সে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল_]
ইমদাদুল হক মিলন : তাহলে ‘লীলাবতী’ নামটি কেন রাখলেন?
[প্রবল ইচ্ছা হলো বলি_আমার ইচ্ছা। তোমার কী?
এই জাতীয় উত্তর দেওয়া যায় না। অনেক পাঠক পড়বে। জ্ঞানগর্ভ কিছু বলা দরকার। জ্ঞানগর্ভ কিছু মাথায় আসছে না। কী করি? উপন্যাসের নাম নিয়ে মিলনের মাথাব্যথার কারণটাও ধরতে পারছি না। আমি বললাম_]
হুমায়ূন আহমেদ : উপন্যাসের নাম হিসেবে ‘লীলাবতী’ নামে যে মাধুর্য আছে ‘সিদ্দিকুর রহমান’ নামে কি সে মাধুর্য আছে?
ইমদাদুল হক মিলন : অবশ্যই এটা একটা সুন্দর নাম।
[মিলন মুখে বলল, এটা একটা সুন্দর নাম; কিন্তু তার চেহারা দেখে মনে হলো সে আমার কথাবার্তায় পুরোপুরি সন্তুষ্ট না। তার চেহারায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তখন আমার মনে হলো_আচ্ছা, মিলন কি ভাবছে আমি ‘লীলাবতী’ নামটি বাণিজ্যিক কারণে রেখেছি? তাই যদি হয় তাহলে তো নামকরণের ব্যাপারটি ভালোমতো ব্যাখ্যা করা দরকার। বইয়ের ফ্ল্যাপে এই ব্যাখ্যা আছে। আমি পরিষ্কার বলেছি_ভারতীয় গণিতজ্ঞ ভাস্করাচার্যের কন্যার নাম ‘লীলাবতী’। এই নামটির প্রতি আমার অস্বাভাবিক দুর্বলতা আছে। তবে আমি এত ব্যাখ্যায় গেলাম না, সরাসরি মূল বিষয়ে চলে গেলাম_]
হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, তুমি যদি মনে করো আমি ‘লীলাবতী’ নামটি দিয়েছি বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনায়, তাহলে ভুল করবে। আমার ভালো লেগেছে, তাই এই নাম দিয়েছি। বইয়ের নামের কারণে কিছু বই বেশি বিক্রি হবে_এটা নিয়ে আমার প্রকাশক মাথা ঘামাতে পারে। আমি ঘামাই না।
[আমার কঠিন কথায় মিলন একটু থমকে গেল এবং অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল_]
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার উপন্যাসের ক্ষেত্রে নাম কোনো ফ্যাক্টর না। আপনি ‘মন্দ্রসপ্তক’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। এই শব্দটির অর্থও অনেকে জানেন না। আপনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটি নাটক লিখেছিলেন_’অয়োময়’। এই শব্দের সঙ্গে বেশির ভাগ বাঙালি পরিচিত নন। আপনার লেখার ক্ষেত্রে নাম কোনো ফ্যাক্টর না। ওইভাবে আমি ভাবিনি।
হুমায়ূন আহমেদ : তার পরও কিন্তু ফ্যাক্টর থাকে, মিলন। আমি দেখেছি। অন্যপ্রকাশ আমার দুটি বই ‘বাসর’ ও ‘সৌরভ’ প্রকাশ করেছে। তুমি দেখবে, ‘বাসর’-এর বিক্রি হয়েছে অনেক বেশি। ‘বাসর’ নামটি হয়তো মানুষকে আকর্ষণ করেছে অনেক বেশি, দেখি তো কী আছে বইটিতে। ‘সৌরভ’ কিন্তু ততটা আকর্ষণ করেনি। ‘সৌরভ’ উপন্যাসটির নাম যদি ‘বাসর’ দিতাম এবং ‘বাসর’ উপন্যাসটির নাম ‘সৌরভ’ দিতাম তাহলেও একই ঘটনা ঘটত।
ইমদাদুল হক মিলন : (বিজয়ীর ভঙ্গিতে) তাহলে তো আপনি স্বীকারই করলেন যে, নামের একটি বাণিজ্যিক ব্যাপার আছে।
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ স্বীকার করলাম। তবে বইয়ের নাম দেওয়ার সময় বাণিজ্যিক ব্যাপারটা আমার মাথায় কখনো থাকে না। যদি থাকত তাহলে ‘সৌরভ’ উপন্যাসটির নাম দিতাম ‘গোপন বাসর’। হা হা হা।
[বুদ্ধিমান পাঠক সম্প্রদায়, আপনারা কি লক্ষ করছেন_মিলন আমাকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিল যে নামের একটা বাণিজ্যিক ব্যাপার আছে। এখন আমার কি উচিত না আরো সাবধানে তার প্রশ্নের জবাব দেওয়া? কে জানে সে হয়তো এমন অনেক কিছু আমার মুখ দিয়ে বলিয়ে নেবে, যা আমার মনের কথা না। কাজেই Attention, সাবধান। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ব্যাপারে সাবধান। মিলন গভীর জলের পাঙ্গাশ মাছ। আমার মতো অল্প পানির ‘তেলাপিয়া’ না।]
ইমদাদুল হক মিলন : আপনি প্রচুর ভূতের গল্প লিখেছেন। অবিস্মরণীয় কিছু ভূতের গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। বৃহন্নলা, দেবী, নিশিথিনী, অন্যভুবন_এই যে লেখাগুলো, এগুলোর মধ্যে আপনি আধিভৌতিক এবং রহস্যময়তার ব্যাপারগুলো সব সময়ই এনেছেন। পাশাপাশি আপনি আবার বললেন যে, বিজ্ঞানের ছাত্রদের এই বিষয়ে বিশ্বাস থাকা ঠিক না। আপনি যখন এই লেখাগুলো লেখেন, তখন কি বিজ্ঞানের ব্যাপারটি মাথায় রেখে লিখেছিলেন?
[মিলন কোন দিকে যাবে বুঝতে পারছি। সে আবারও আমাকে দিয়ে স্বীকার করাবে যে আমি নিজেকে ‘কনট্রাডিক্ট’ করছি। একই সঙ্গে বিজ্ঞানের কথা বলছি আবার ভূত-প্রেতের কথা বলছি। অতি সাবধানে এখন উত্তর দিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় প্রশ্নগুলো পাশ কাটিয়ে যাওয়া।]
হুমায়ূন আহমেদ : বিজ্ঞান তো থাকবেই। কিন্তু সব ব্যাখ্যা কি বিজ্ঞান দিতে পারছে? মহাবিশ্বের শুরু হলো বিগ ব্যাং (Big Bang) থেকে। তার আগে কী ছিল?
[মিলন ভুলবার মানুষ না। সে এই বিষয়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল। আমাকে ঠেলা ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলতে চাচ্ছে…]