‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ এবং ‘অচিনপুর’ এই দুটি রচনা ময়মনসিংহ শহরে লেখা। তখন ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। কাউকেই চিনি না। কথা বলার লোক নেই, গল্প করার কেউ নেই। কিচ্ছু ভালো লাগে না। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে হাঁটাহাঁটি করি। একসঙ্গে অনেক গল্প মাথায় আসে। ইচ্ছা করে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে দিনরাত লিখি। শুধুই লিখি। কত কথা আমার বুকে জমা হয়ে আছে। সব কথা সবাইকে জানিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। কারো সঙ্গে দেখা হলেই মনে হয়— এই মানুষটার জীবনটা কেমন ? কী গল্প লুকিয়ে আছে তার ভেতরে ? কিন্তু আগ বাড়িয়ে তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে না। সব সময় নিজেকে সরিয়ে রাখতে চাই। স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি যখন ঘরের একটি নিরিবিলি কোণ পেয়ে যাই, যেখান থেকে সামান্য একটু আকাশ দেখা যায়। এক চিলতে রোদপোষা বেড়ালের মতো পায়ের কাছে পড়ে থাকে। আমি বসে যাই কাগজ-কলম নিয়ে—‘আমি বলি এই হৃদয়েরে। সে কেন জলের মত ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়।’
লিখে যাচ্ছি ক্রমাগত। কুড়ি বছর হয়ে গেল লেখালেখির বয়স। খুব দীর্ঘ সময় না হলেও খুব কমও তো নয়। অনেক লেখকই ক্রমাগত কুড়ি বছর লিখতে পারেন না। মৃত্যু এসে কলম থামিয়ে দেয়। কেউ কেউ আপনাতেই থেমে যান। তাদের লেখার ইচ্ছা ফুরিয়ে যায়। আমার অসীম সৌভাগ্য, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে লেখার ইচ্ছা বেড়েই চলছে। আজকাল প্রায়ই বলতে ইচ্ছা করে— ‘জীবন এত ছোট কেন ?’
উপন্যাস সমগ্র-১ম খণ্ড, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ১৯৯০
এই যে এত লিখছি, কী বলতে চাচ্ছি এসব লেখায় ? ‘চারপাশের দুঃসময়, গ্গ্নানিময় এবং রহস্যময় জগৎকে একজন লেখক গভীর মমতায় ভালোবাসেন’—এই কি আমার লেখার সার কথা ? নাকি এর বাইরেও কিছু আছে ? আমি জানি না—আমার জানতে ইচ্ছাও করে না। আমার ইচ্ছা করে—থাক। সব কথা বলে ফেলা ঠিক হবে না। কিছু রহস্য থাকুক।
হুমায়ূন আহমেদ
শহীদুল্লাহ হল।
মিসির আলী অমনিবাস, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ১৯৯৩
‘মিসির আলির কথা’ শিরোনামে নিজের কথা বলে নিই আমি। তখন থাকি নর্থ ডেকোটার ফার্গো শহরে। এক রাতে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি মন্টানায়। গাড়ি চালাচ্ছে আমার স্ত্রী গুলতেকিন। পেছনের সিটে আমি আমার বড় মেয়েকে নিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছি। গুলতেকিন তখন নতুন ড্রাইভিং শিখেছে। হাইওয়েতে এই প্রথম বের হওয়া। কাজেই কথাবার্তা বলে তাকে বিরক্ত করছি না। চুপ করে বসে আছি এবং খানিকটা আতঙ্কিত বোধ করছি। শুধু মনে হচ্ছে, অ্যাকসিডেন্ট হবে না তো ? গাড়ির রেডিও অন করা। কান্ট্রি মিউজিক হচ্ছে। ইংরেজি গানের কথা মন দিয়ে শুনতে ইচ্ছে করে না। কিছু শুনছি, কিছু শুনছি না এই অবস্থা। হঠাৎ গানের একটা কলি শুনে চমকে উঠলাম—
বাঃ, মজার কথা তো! আমি নিশ্চিত, মিসির আলি চরিত্রের ধারণা সেই রাতেই আমি পেয়ে যাই। মিসির আলি এমন একজন মানুষ, যিনি দেখার চেষ্টা করেন চোখ বন্ধ করে। যে পৃথিবীতে চোখ খুলেই কেউ দেখে না, সেখানে চোখ বন্ধ করে দেখার এক আশ্চর্য ফলবতী চেষ্টা।
আরো অনেক দিন পর ‘দেবী’ লিখি। মিসির আলি নামের অতি সাধারণ মোড়কে একজন অসাধারণ মানুষ তৈরির চেষ্টা ‘দেবী’তে করা হয়—একজন মানুষ, যাঁর কাছে প্রকৃতির নিয়ম-শৃঙ্খলা বড় কথা, রহস্যময়তার অস্পষ্ট জগৎ যিনি স্বীকার করেন না। সাধারণত যুক্তিবাদী মানুষরা আবেগবর্জিত হন। যুক্তি এবং আবেগ পাশাপাশি চলতে পারে না। মিসির আলির ব্যাপারে একটু ব্যতিক্রমের চেষ্টা করলাম। যুক্তি ও আবেগকে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে দিলাম। দেখা যাক কী হয়।
যা হল তা অভাবনীয়! পাঠকরা মিসির আলিকে গ্রহণ করলেন গভীর ভালবাসায়। তাঁদের কাছে মিসির আলি শুধু গল্পের চরিত্র হয়ে থাকল না, হয়ে গেল রক্তমাংসের একজন—বিপদে যার কাছে ছুটে যাওয়া যায়।
আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করা হয়, মিসির আলি বলে কি আসলেই কেউ আছে ? এই চরিত্রটি কি আমি কাউকে দেখে তৈরি করেছি ? তাঁদের অবগতির জন্যে বিনীতভাবে জানাই—না, মিসির আলিকে আমি দেখিনি। অনেকে মনে করেন, লেখক নিজেই হয়তো মিসির আলি। তাঁদেরকেও বিনীতভাবে জানাচ্ছি—আমি মিসির আলি নই। আমি যুক্তির প্রাসাদ তৈরি করতে পারি না এবং আমি কখনো মিসির আলির মতো মনে করি না—প্রকৃতিতে কোনো রহস্য নেই। আমার কাছে সব সময় প্রকৃতিকে অসীম রহস্যময় বলে মনে হয়।
মিসির আলিকে নিয়ে বেশ কিছু লেখা লিখেছি। কিছু ভুলভ্রান্তিও করেছি। যেমন ‘অন্য ভুবনে’ মিসির আলিকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছে। এটি বড় ধরনের ভুল। এই চরিত্রটি বিবাহিত পুরুষ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। মিসির আলিকে একজন নিঃসঙ্গ মানুষ হিসেবেই মানায়, যিনি ভালবাসার গভীর সমুদ্র হৃদয়ে লালন করেন; কিন্তু সেই ভালবাসাকে ছড়িয়ে দেবার মতো কাউকেই কখনো কাছে পান না।
ভুলত্রুটি সত্ত্বেও আমার প্রিয় চরিত্রের একটি হচ্ছে মিসির আলি। মিসির আলিকে নিয়ে লিখতে আমার সব সময়ই ভালো লাগে। এই নিঃসঙ্গ, হৃদয়বান, তীক্ষষ্ট ধীশক্তির মানুষটি আমাকে সব সময় অভিভূত করেন। যতক্ষণ লিখি ততক্ষণ তাঁর সঙ্গ পাই, বড় ভালো লাগে।
হুমায়ূন আহমেদ