সাব্বির খানঃ আপনি থামবেন কোথায়? লেখালেখিতে, সিনেমায় না অন্য কিছুতে? নাকি সবকিছু একসাথে নিয়ে চলবেন, কোথাও থামবেন না? শিক্ষকতায় ফিরে যাবেন কি?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমি লিখে যাবো। অন্য কিছুর কি হবে জানিনা, তবে লেখালেখি থামবেনা। আর আমরাতো ভবিষ্যতের ব্যাপারে খুব একটা ভাবিনা। তাই জানিনা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামবে। আমরা হচ্ছি, “প্রডাক্ট অব দ্য প্রেজেন্ট”! প্রেজেন্ট নিয়েই আমাদের সমস্যা বেশি।
সাব্বির খানঃ আপনি কিছুক্ষন আগে বলেছেন যে, আমরা খুব স্লো-জাতী। এটা যদি আমাদের জন্য একটা নেতিবাচক দিক হয়, তাহলে আমাদের ঠিক হওয়ার জন্য কি করা উচিত?
হুমায়ুন আহমেদঃ এটাকে ঠিক করার কিছু নাই। এটা যেমন সেরকমই থাকবে। এর মাঝখান থেকে নতুন নতুন ছেলেপেলে বেরোচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। তারা খুবই স্মার্ট, খুবই আধুনীক। বাংলাদেশকে পরিবর্তন করার দায়িত্ব এদের। এরা করবে।
সাব্বির খানঃ আপনিতো বাংলাদেশ প্রচন্ড জনপ্রিয়। আপনার এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে সমস্যা সমাধানের লক্ষে কিছু একটা করা যায়না?
হুমায়ুন আহমেদঃ একজন লেখক কিন্তু সমস্যার প্রতি ইঙ্গিত করতে পারেন, কিন্তু সমস্যার সমাধান তিনি দেবেন না বা এটা তার দায়িত্ব না।
সাব্বির খানঃ এটা কার দায়িত্ব?
হুমায়ুন আহমেদঃ এ দায়িত্বটা রাজনীতিবিদদের। সমাজ সংস্কারকের দায়িত্ব। একজন লেখক রাজনীতিবিদ না, বা সমাজ সংস্কারক না। এটা তার দায়িত্বও না।
সাব্বির খানঃইঙ্গিত থাকবে কিন্তু প্রস্তাবনা থাকবেনা, এটা কি ঠিক?
হুমায়ুন আহমেদঃ ইঙ্গিতের ভিতরেইতো প্রস্তাবনা থাকে। কিন্তু সেগুলোকে গুরুত্ত্বের সংগে বিবেচনা করার কিছু নাই।
সাব্বির খানঃ আমাদের রাজনীতিবিদ বা প্রশাসনগুলো কি এই ইঙ্গিত বা প্রস্তাবনাগুলো যাচাই করে থাকেন?
হুমায়ুন আহমেদঃ না না না। এই সমস্ত ইঙ্গিত বা প্রস্তাবকে গুরুত্ত্বের সংগে নেয়ার কিছু নাই। আমাদের মুসলমানদের কথাই যদি ধরি। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট পবিত্র গ্রন্থ কোরান যদি আমাদের চেঞ্জ করতে না পারে, একজন ঔপোন্যাসিক কি একটা উপন্যাস লিখে তাদের চেঞ্জ করতে পারবেন? সেটা কিভাবে সম্ভব?
সাব্বির খানঃ লেখক হুমায়ুন আহমেদের সমাজের প্রতি অঙ্গিকার বা দায়বদ্ধতা কি?
হুমায়ুন আহমেদঃ লেখক হিসেবে আমার অঙ্গিকার একটাই, যে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের জন্ম, সেই মুক্তিযুদ্ধের কথা সবাইকে জানিয়ে রাখা। কারন আমি যখন একজন যুবক, তখন সেই যুবকের দৃষ্টি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধটি দেখেছি।
সাব্বির খানঃ আপনিতো মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। আপনার দৃষ্টিতে একাত্তরের মৌলবাদ ও মৌলবাদী এবং বর্তমানের মৌলাবাদ ও মৌলবাদীর মধ্যে তফাৎ কোথায়?
হুমায়ুন আহমেদঃ একাত্তরের মৌলবাদ ও মৌলবাদীরা ছিল একটা বিদেশী শক্তির অর্থাৎ পাকিস্তানের অংশ। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে যে মৌলবাদ ও মোলবাদীরা কোন বিদেশী শক্তির অংশ না। এটাই পার্থক্য। তবে আমাদের এতো মৌলবাদ-মৌলবাদী বলে চিৎকার করে লাভ নেই কিছু, কারন বিশ্বের সব দেশেই এখন এসব আছে। ইন্ডিয়াতে আছে বিজেপি, আমেরিকাতে আছে ক্লু ক্লাক্স ক্লান, সারা পৃথিবীতেই আছে মৌলবাদী।
সাব্বির খানঃ বাংলাদেশে মৌলবাদের সমস্যা কি সমস্যা না? বিএনপি-জামাত সরকারের সময়ে বাংলা ভাই, শায়খুল, ৬৩টা জেলায় এক সাথে বোমাবাজী এসব কি সমস্যার আওতায় পড়ে না?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমি মনে করি না। বাংলাদেশে মৌলবাদের সমস্যা এতো বড়ো কোন সমস্যা এখনো হয়নি। জনগন যদি ভোট দিয়ে মৌলবাদিদের নির্বাচন করে, গনতান্ত্রিকভাবে কি তাদের বাদ দেয়া যায়? হোক না তারা মৌলবাদী।
সাব্বির খানঃ এই দুর্মূল্যের বাজারে বাংলাদেশ এবং বাঙ্গালীরা এখন কেমন আছে?
হুমায়ুন আহমেদঃ সবাই খুবই ভালো আছে। বিশ্বের সব জায়গায়ই দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। এখনো বাংলাদেশে চালের দাম বিশ্বের যে কোন জায়গার চেয়ে কম।
সাব্বির খানঃবাংলাদেশের বর্তমান সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমি তাদের খুব ভালো দৃষ্টিতে দেখি। তারা খুব ভালো কাজ করছে।
সাব্বির খানঃ একটা স্বাধীন দেশে এতদিন জরুরী অবস্থা জারী করে রাখা কি উচিত?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা এতদিন দেশটাকে যে অবস্থা করে রেখেছিল, আগামী আরো দুবছরও যদি জরুরী অবস্থা জারী থাকে, আমি তার বিরূদ্ধে একটি কথাও বলবো না। কারোর পক্ষে কখনোই কি সম্ভব ছিল তারেক জিয়া, কোকো এদেরকে জেলে ঢোকানো? এর পরে যদি আওয়ামী লীগ সরকারও আসতো, পারতো কি এদের ধরে ধরে জেলে ঢোকাতে? কখনোই পারতো না। কারন একাজ করতে গেলে সবার থলেরই বিড়াল বেরিয়ে পড়তো। প্রত্যেকেইতো যার যার থলেতে একটা করে বিড়াল নিয়ে ঘুরছে।
আমাদের যে জেনারেল মইন ঊ আহমেদ, খুব নরম মনের মানুষ, কিন্তু খুব শক্ত। যেই ইন্ডিয়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করলো, আমাদের জেনারেল ভারতে গেলেন, সেখানে যারা বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছে, তাদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসলেন, সম্মান দিলেন। এই কাজটা কি আওয়ামী লীগ সরকার করতে পারতো না? আমাদের জাতী হিসাবে একটা কৃতজ্ঞতাবোধ থাকবেনা? এতোগুলো ভারতীয় সৈন্য আমাদের জন্য আত্নত্যাগ করলো, আমরা কি পারতাম না তাদের স্মরনে একটা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করতে? আমরা করিনি কিন্তু! একটা অন্য দেশের সন্তানরা আমাদের দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, এটা আমাদের মনে রাখা উচিত ছিল।