সাব্বির খানঃ দেশীয় এবং ইউরোপীয়ান ক্যামেরাম্যানের মধ্যে পার্থক্য কি?
হুমায়ুন আহমেদঃ এই দুই ক্যামেরাম্যানের মধ্যে প্রথমতঃ শিক্ষাগত পার্থক্য। ইউরোপীয়ানরা ক্যামেরা বিষয়ক সমস্ত থিওরী জানে। আর আমাদের দেশের ক্যামেরাম্যানরা হচ্ছে গুরুর কাছ থেকে শেখা, অর্থাৎ গুরুমুখী বিদ্যায় শিক্ষিত। তারা গুরুর কাছ থেকে আস্তে আস্তে সবকিছু শিখে নেয়। আমাদের ক্যামেরাম্যানদেরকে ছোট করার কোনই কারন নাই। এদের অভিজ্ঞতা খুব বেশি। এরা ২০-২৫ বছর ধরে কাজ করছে। আমি নিজে দেখেছি, এরা ক্যামেরার আওয়াজ শুনে বলে দিতে পারে যে, ক্যামেরাটা রান করছে, না স্লো হয়ে যাচ্ছে। এটা শুধুই দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কারনে সম্ভব।
সাব্বির খানঃ কেন দেশী এবং বিদেশী দুই ধরনেরই ক্যামেরাম্যান নিয়ে কাজ করবেন? তাতে অসুবিধা হবেনা?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমাদের দেশটা হচ্ছে খুব স্লো, এশিয়ার সব দেশই বলা যায় স্লো এবং এই স্লো ব্যাপারটা ছবিতেও চলে আসে। একটা উদাহারন না দিলে বোঝা যাবে না, ধর তুমি একটা কাগজে কিছু একটা লিখছো। ক্যামেরাটা তোমার মুখের উপরে ধরা। সেখান থেকে ক্যামেরাটা কাগজের উপর নামবে। আমাদের দেশের ক্যামেরাম্যানরা খুব স্লোলী ক্যামেরাটা মুখ থেকে কাগজের উপর নামাবে, অথবা মুখ থেকে কাট করে দ্বিতীয় শটে কাগজটা দেখাবে। ইউরোপীয়ান ক্যামেরাম্যানরা ধাম করে নীচে নামাবে। এরা খুব দ্রুত। আমাদের দেশে সে স্পিডটা নাই। আমরা জাতীগতভাবে স্লো, দেশটা স্লো, কথাবার্তায় স্লো। আমরা সবকিছুতেই খুব স্লো। আমি চাই, ফিল্মের ইউরোপীয়ান পর্ব যেটা হবে, সেটা হবে ইউরোপীয়ান স্টাইলে, খুব ফাস্ট। আর বাংলাদেশী পর্ব যেটা হবে, সেটা হবে আমাদের দেশীয় স্টাইলে, খুব স্লো। তাতে স্পস্ট একটা পার্থক্য তৈরি হবে।
সাব্বির খানঃ ছবিটার নাম কি হবে?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমার “নক্ষত্রের রাত” নামের উপন্যাস অবলম্বনে হবে এই ছবিটা। উপন্যাসের নামে অবশ্য ছবির নাম হবে না। ছবির নাম এখনো ঠিক করা হয়নি। তবে প্রথমিকভাবে “ চোখে আমার তৃষ্ণা ” নামটি ঠিক করেছি ছবির জন্য। এটা রবীন্দ্র নাথের গানের একটা লাইন। তবে নামটা বদলানো হতে পারে।
সাব্বির খানঃসুইডিশ কোন অভিনেতা-অভিনেত্রী থাকছেন কি এই ছবিতে?
হুমায়ুন আহমেদঃ হ্যা থাকছে। অনেকেই অভিনয় করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
সাব্বির খানঃ সুইডিশদের সাথে কাজ করতে কেমন লাগছে?
হুমায়ুন আহমেদঃ ভালোই লাগছে। তবে ওরা খুব রোবোটিক । ওরা হুকুমের বাইরে এক পা-ও নড়বেনা। ওদের যা বলে দেয়া হচ্ছে, ওরা ঠিক ততটুকুই করছে। তার বাইরে না। ওদের বলেছি মাঝে মাঝে একটু ইম্প্রোভাইস করতে, কিন্তু তারা তা করছে না। শুধু আমি যতটুকু বলছি, ততটুকুই করছে। তবে তারচেয়েও বেশি অসুবিধা হচ্ছে লাইটিংয়ের ব্যাপারে। ডিজিটেলেতো লাইটের খুব একটা বেশি প্রয়োজন পড়ে না, আর আমি প্রচুর লাইট নিয়ে কাজ করতে অভ্যস্ত। তাতে আমার বেশ একটু অসুবিধা হচ্ছে। তবে দেখা যাক, কাজতো এগিয়ে চলছে!
সাব্বির খানঃ এই ছবিটা তৈরিতে খরচ কেমন হবে বলে মনে করছেন?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমার সব ছবিতে সাধারনত এক কোটি টাকার মতো খরচ হয়। আমার মনে হয়, এটাতেও তাই হবে। ইউরোপে টাকার এই অংকটা খুবই কম হলেও, আমাদের দেশে অনেক বেশি।
সাব্বির খানঃ সুইডেনে আপনি এখন শুটিং করছেন এবং আগেও এসেছেন। সুইডেন এবং বাংলাদেশের মধ্যে আপনি কোন ব্যাপারগুলোর মিল বা অমিল খুঁজে পান?
হুমায়ুন আহমেদঃ মিল তেমন কিছু নাই। বাংলাদেশের মানুষরা খুব সুখী মানুষ। ধরুন, বন্যায় ঘর ডুবে গেছে, ঘরের চালের উপর আশ্রয় নিয়েছে মানুষ, ঠিক তখন সেখান দিয়ে দেশী বা বিদেশী কোন টিভি টিম যাচ্ছে, তখন তারা কি করবে? হাসবে অথবা হাত নাড়বে। এই ঘটনা সুইডেনে কখনোই সম্ভব না। এটা শুধুই আমাদের দেশে সম্ভব। আবার পেটে ভাত নাই, নৌকায় কোথাও যাচ্ছে। নৌকায় চড়েও দেখবেন একটা গান ধরছে। এটা আমাদের দেশেই সম্ভব। সুইডিশরা তা পারবেনা।
সাব্বির খানঃ আপনি বলতে চান যে বাংলাদেশের মানুষ আসলেই খুব সুখী?
হুমায়ুন আহমেদঃ অবশ্যই। কিছুদিন আগে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষদের দেশের একটা তালিকা বের করেছিল। সেখানে বাংলাদেশ ছিলো পাচ নাম্বারে। দুর্নীতির তালিকায় এক নাম্বারে থাকলেও সুখীর তালিকায় কিন্তু পাঁচ নাম্বারে।
সাব্বির খানঃ আপনিতো মুলতঃ একজন লেখক। কিন্তু আপনি একই সাথে নাট্যকার ও চলচিত্র পরিচালক। আপনি নিজেকে কি হিসেবে দেখতে ভালোবাসেন?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমি আসলেই একজন লেখক। আমি নিজেকে বলি ফিকশন রাইটার। কখনোই আমি নিজেকে ফিল্মমেকার বলিনা। ছবি দেখার প্রতি ছোটবেলা থেকেই আমার খুব আগ্রহ ছিল। আমি কত সুন্দর সুন্দর ছবি দেখি, কিন্তু আমাদের দেশে সেরকম বানাতে পারছেনা। এত বড় একটা মুক্তিযুদ্ধ হলো, অথচ মুক্তিযুদ্ধের উপর একটা ছবি নাই। এই আফসোস থেকেই প্রথম মুক্তিযুদ্ধের উপর একটা ছবি বানালাম “আগুনের পরশমনি”। এই ছবি করতে সমস্ত খরচ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তারপর থেকে চালিয়ে যাচ্ছি ছবি বানানো। আসলে ছবির লাইনটা হচ্ছে একটা নেশার মতো। সিগারেটের যেমন নেশা, গাঁজার যেমন নেশা, সিনেমা বানানোর নেশা তারচেয়েও বেশি।