বিবিসিঃ এটা কি মৃত্যুর সময়? আপনি কি ভাবে বুঝতে পারবেন?
হুমায়ূন আহমেদঃ বোঝা যাবে। বোঝা যায় না? অনেকেই তো বলে টের পায় যে আমি মারা যাচ্ছি। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ওই যে কি শেষ নিঃশ্বাস ফেলার জন্য শারীরিক প্রস্তুতি। মৃত্যু তো শুধু হার্ট বন্ধ হয়ে যায় তা না। মৃত্যু তো প্রতিটি জীবকোষ – প্রতিটি কোষ মারা যায়। প্রতিটি কোষের মৃত্যু তো একটি ভয়াবহ ব্যাপার। বুঝতে পারার তো কথা।
বিবিসিঃ তো আপনি শেষ পর্যন্ত লেখালেখি চালিয়ে যেতে চান?
হুমায়ূন আহমেদঃ আমি পারব কিনা আমি জানি না । আমার গোপন ইচ্ছা এবং প্রগাঢ় ইচ্ছা হচ্ছে যে মৃত্যুর এক/দেড় ঘন্টা আগে যেন আমি এক লাইন বাংলা গদ্য লিখতে পারি। যেন হা হুতাশ করে না মরি। এই মইরা গেলাম রে, বাঁচাও রে। এই আল্লাহ-খোদাকে ডাকাডাকি করতেছে। এটা না করে আমি প্লেন এন্ড সিম্পল লাস্ট একটা ওয়ান লাইন আমি লিখতে চাই। এখন তুমি যদি বল কি সেটা – সেটা আমার মাথায় আছে; তোমাকে আমি বলব না।
বিবিসিঃ অনেক ধন্যবাদ। আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য ।
হুমায়ূন আহমেদঃ অর্চি , তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ। তুমি অনেক ভাল থাক এবং মানুষের ইন্টারভিউ নিয়ে ব্যস্ত থাক। যাও।”
[অনুলিখন : আনোয়ার জাহান ঐরি, চলন্তিকা ডট কম।]
সাক্ষাৎকার – জুলাই, ২০০৮ (দৈনিক সমকাল)
১৮ জুলাই ২০০৮ সালে সুইডেনে হুমায়ুন আহমেদ দৈনিক সমকালের সাংবাদিক সাব্বির রহমান খান কে একটা সাক্ষাৎকার দেন।
সাব্বির খানঃ আপনাকে স্যার বলছি, ঠিক আছে?
হুমায়ুন আহমেদঃ ২২ বছর মাস্টারী করেছি, স্যার বলবে নাতো কি বলবে। ২ বছর আমেরিকায়, আর বাকী সময় বাংলাদেশে। সারা বাংলাদেশে সবাই-ই আমাকে স্যার ডাকে। এখন বলো, আমার কোন ইন্টারভিউ তো না?
সাব্বির খানঃ আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি। কিছু কথা জানার আগ্রহ নিয়েই আমার আসা।
হুমায়ুন আহমেদঃ আমিতো ইন্টারভিউ দেশেও দেইনা, তাই বাইরে এসে যদি ইন্টারভিউ দেয়া শুরু করি, তাহলে দেশের সাংবাদিকদের জন্য সেটা হবে অস্বস্তিকর ব্যাপার। তারা খুব ভালো ভাবে জানে যে, আমি ইন্টারভিউ দেইনা। এই হলো প্রব্লেম।
সাব্বির খানঃ সুইডেনে আপনার ছবির শুটিং সম্বন্ধে একটু জানতে এসেছি। সুইডেনকে শুটিংয়ের জন্য কেন বেছে নিলেন?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমি সুইডেনে যে ব্যাপারে এসেছি, তার মেইন ব্যাপারটা সংক্ষেপে বলি। আমরা বাংলাদেশে ছবি বানাই ৩৫ মিমি ক্যামেরায়। ওই ছবিগুলোতে প্রয়োজন হয় ফিল্মের। ফিল্মে ছবিগুলো এক্সপোজড হয়। যেহেতু পৃথিবী বহুদুর এগিয়ে গিয়েছে, এখন শুরু হয়েছে ফটোগ্রাফি ডিজিট্যালি নেয়া। যদি ডিজিটেলি ফটোগ্রাফি করা হয়, তাহলে অনেক কিছু করা যায়। ফিল্মে ফটোগ্রাফিতে বেশি কিছু করা যায়না। ডিজিটেল ফটোগ্রাফিতে একটাই সমস্যা হয়, তাহলো Depth of field এর সমস্যা। ধরুন আমরা যদি ৩৫ মি.মি.-এ দুজনকে ধরি, তাহলে দুজনের পিছনে যা থাকবে, তা থাকবে খুবই ক্লিয়ার এবং এটা খুবই ইন্টারেস্টিং। কিন্তু ডিজিটেলি এটা করতে পারে না। তবে নতুন একটা টেকনোলজি এসেছে। সেটা হচ্ছে কি, একটা হাই ডেফিনিশন ভিডিও ক্যামেরা ব্যাবহার করে, তার সাথে একটা এডাপ্টার লাগায়। তার পরে যে সমস্ত লেন্সগুলো আছে, সেগুলো বসায়। এই প্রক্রিয়ায় যে রেজাল্ট হয়, তা ৩৫ মিমি ক্যামেরার খুব কাছাকাছি। হলিউডে যে সব ছবি করা হয়, তারা তাতে এই টেকনোলজি ব্যাবহার করে, যা দুএকটা উদাহার আমি দেখেছি। তাতে কোন রকম পার্থক্য আমি পেলাম না ৩৫ মি.মি. ক্যামেরার ফিল্মের সাথে। কিন্তু বোম্বেতে কিছু ছবি তারা করেছে, তাতে বোঝা যায় যে, ওগুলো ভিডিওতে করা। হলিউডের ছবিগুলোতে তা বোঝা যায়না। যেহেতু নতুন জিনিসের প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ আছে বলে আমরা ঠিক করলাম যে আমরা চেষ্টা করবো এই টেকনোলজি ব্যাবহার করে। প্রথম কারন হচ্ছে নূতন একটা টেকনোলজির কাছে যাওয়া, আর দ্বিতীয় কারন হচ্ছে, এটা এতো এক্সপেন্সিভ না। আর তৃতীয় কারন হচ্ছে, কম্পিউটারের মাধ্যমে আমরা যে চেঞ্জগুলো করতে পারবো, ৩৫ মি.মি. তা সম্ভব না। এই তিনটি কারনে উৎসাহীত হলাম। তারপরে মাসুদ আখন্দ (সহকারী পরিচালক) এই এডাপ্টারটা যোগার করেছে এবং লেন্সগুলো তাতে সেট করা যাচ্ছে, তাই ঠিক করলাম যে ছবির প্রথম পর্বটা সুইডেনে করবো এবং দ্বিতীয় পর্বটা বাংলাদেশে করবো। যেহেতু এই টেকনিকে আমি অভ্যস্ত না, তাই এটা দিয়েই শুরু করলাম।
সাব্বির খানঃ সুইডেনে আপনি শুটিং করতে গিয়ে কোন ধরনের সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছেন?
হুমায়ুন আহমেদঃ নানাবিধ সমস্যা আছে এখানে। প্রথমতঃ লোকবলের সমস্যা, দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, এখানে প্রতিটা জিনিসই খুব এক্সপেন্সিভ। যেমন আমি যে একটা ক্রেন ভাড়া করবো, যেটা উপর থেকে নীচে যাবে বা নীচ থেকে উপরে যাবে, সেটা ভাড়া করতে পারছিনা। তাতে আমাদের বাজেটে কুলোবে না। কিন্তু দেখা যাক কি হয়। কাজতো শুরু করলাম। আগামি শীতে আবার যখন আসবো, তখন এখনকার শুটিংয়ে যে ত্রুটিগুলো ধরা পড়বে, সেগুলোর আবার নতুন করে শট নেবো। যেহেতু আমাদের ছবিতে গ্রীস্মের এবং শীতের দুটি পর্ব আছে, সেহেতু আমাদের এখানে দুবারই আসতে হবে। গ্রীস্মেরটা এখন হয়ে গেলো, শীতেরটা পরে হবে। আমার পরিকল্পনা ছিল স্কটল্যান্ডে এই ছবিটা করতে। কিন্তু এখানে যেহেতু মাসুদ আছে, সে ফিল্ম লাইনে পড়াশুনা করেছে। তার মেধা এবং অভিজ্ঞতাকে ব্যাবহার করা যাবে এবং তার কম্পিউটারের জ্ঞ্যান ভালো, সেটাকে পুরোপুরিভাবে ব্যাবহার করা যাবে। সর্বোপরি, এখানকার ছেলেমেয়েরা আগ্রহ নিয়ে কাজ করবে। এই সব বিষয় বিবেচনা করে ভাবলাম যে, এই জায়গাটা ঠিক আছে। এইভাবেই আমরা ছবিটা তৈরিতে অগ্রসর হয়েছি। পূর্বে দেশীয় ক্যামেরাম্যান নিয়ে কাজ করেছি। এবার ইউরোপে একজন ইউরোপীয়ান ক্যামেরাম্যান নিয়ে কাজ করছি। দেশের অংশটা দেশীয় ক্যামেরাম্যান নিয়ে করবো।