হুমায়ূন আহমেদঃ না, হিমুতে আমি আসলে পরিচিত কাউকে তুলে ধরিনাই। যে হিমু আমি লিখি ঐ হিমু হওয়া খুবই জটিল ব্যাপার তো বটেই। আমি মানুষের অনেক আশা –ইচ্ছা পূরণের ব্যাপার আছে মানুষ অনেক কিছু করতে চায় কিন্তু করতে পারে না। মানুষের যে ইচ্ছাপূরণের যে বিষয়গুলো আছে সেগুলো আমি হিমুর মাধ্যমে ঐ ইচ্ছাপূরণের ব্যাপারগুলো ঘটাই। যে কারণেই আমার ধারণা পাঠক এটাকে এতো পছন্দ করে। এরা হতে চায়। এরা করতে চায়। এরা চায় প্রত্যেকেই যে আমার একটা আধ্যাত্বিক ক্ষমতা থাকবে। মানুষের ভুত-ভবিষ্যত বলে দিতে পারব। সবার ভেতরে এটা একটা গোপণ বাসনা। ওদের গোপন বাসনা আমি পথে ঘাটে হেটে বেড়াবো- কেউ আমাকে কিছু বলবে না। আমাকে চাকরি করতে হবে না। কোন কিছুই করতে হবে না। আমার জীবন চলবে জীবনের মতো। কোন বাড়ির সামনে গিয়ে যদি দাড়াই ওরা আমাকে খাবার দিবে। এই যে গোপন ইচ্ছেগুলো যেগুলো থাকে সেই ইচ্ছেগুলি আমি পূরণ করি হিমু উপন্যাসে। কাজেই কারো সাথে যে মিল আছে এটা মনে হয় না।
বিবিসিঃ আচ্ছা মিঃ আহমেদ, এই হিমু তো পাঠকদের কাছে প্রায় অনুকরণীয় একটা চরিত্র হয়ে দাড়িয়েছে। এই হিমুকে নিয়ে মানুষের উচ্ছ্বাস সম্পর্কে কোন বিশেষ কোন ঘটনা আছে কি যা আপনাকে নাড়া দিয়েছে?
হুমায়ূন আহমেদঃ হ্যাঁ, একটা বলা যেতে পারে। আমি হঠাৎ করে ইয়ে থেকে একটা ম্যাগাজিন পেলাম রাশিয়া এম্বাসী থেকে। ও ই ম্যাগাজিনে দেখি কি ওদের রাশিয়াতে একটা হিমু ক্লাব আছে। ওই হিমু ক্লাবের সদস্যরা সবাই কিন্তু রাশিয়ান; বাংলাদেশী ছেলে-পেলে না। ওরা একটা অনুষ্ঠান করেছে সেই অনুষ্ঠানে সব এম্বাসেডরদের ডেকেছে। এম্বাসেডরদের হলুদ পোশাক পরতে হবে। তারা জানে এম্বাসেডররা হলুদ পোশাক পরবেন না। কাজেই ঐ ক্লাবের তরফ থেকে প্রতিটি এম্বাসেডরকে একটি করে হলুদ নেকটাই দেয়া হয়েছে। তারা এই হলুদ নেকটাই পরে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। এটা শুনে বা বইয়ের লেখাতে পড়ে আমি খুবই একটা ধাক্কার মতো খেয়েছিলাম।
আরেক বার ধাক্কা খেয়েছি জার্মানীতে। জার্মানীতে গিয়েছিলাম আমি ফ্রাঙ্কফুর্ট বই মেলায়। সেখানে একটা বাসায় একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। এক ছেলে এসে আমাকে বলল যে, স্যার, আমি কিন্তু হিমু। হলুদ একটা কোট গায়ে দিয়ে আসছে। আমি বললাম, তুমি হিমু। হিমুর তো খালি পায়ে থাকার কথা। এই প্রচন্ড ঠান্ডা জার্মানীতে। তোমার কি খালি পা? বলল, স্যার, দেখেন। তাকিয়ে দেখি তার খালি পা। ওই দিনও আমি ধাক্কার মতো খেয়েছিলাম।
বিবিসিঃ বাংলাদেশে সাধারণত দেখা যায়, যারা নতুন লেখালেখি শুরু করে নতুন বই প্রকাশ করতে তাদেরকে যথেষ্ট কষ্ট করতে হয়। আপনি যখন প্রথম উপন্যাস লিখেছিলেন তখন সেটা প্রকাশ করতে কি আপনার কি রকম প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল?
হুমায়ূন আহমেদঃ খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে আমাকে তেমন কোন প্রতিকুলতার সম্মুখীন হতে হয়নি। আমার প্রথম উপন্যাসের নাম “নন্দিত নরকে”। এটি প্রকাশ করতে খুব একটা সমস্যা হয়েছে আমি মনে করি না। কারণ, আহমদ ছফা বলে এক জন ছিলেন আমাদের দেশের খুবই স্পিরিটেড এক জন মানুষ। তিনি উপন্যাসটি পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। এই উপন্যাসটি যে কোন কারণেই তার খুব মনে ধরেগিয়েছিল। তিনি জান দিয়ে ফেললেন এটি প্রকাশ করার জন্য। এই উপন্যাসের পান্ডুলিপি বগলে নিয়ে তিনি প্রায় প্রতিটি প্রকাশকের ঘরে ঘরে গেলেন। আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি তো। আমি ব্যাপারটি জানিই না। শুধু ছফা ভাইয়ের সাথে দেখা হয় । ছফা ভাই খবর দেন – আজকে অমুকের কাছে গেছি, কালকে অমুকের কাছে গেছি। এভাবে বলে বলে তিনি এক জন প্রকাশককে মোটামুটি কনভিনসড করে য়েললেন যে উপন্যাসটি প্রকাশ করতে হবে।কাজেই উপন্যাস প্রকাশিত হয়ে গেল। উপন্যাসটি প্রকাশিত হবার আগে প্রকাশকের সাথে আমার পরিচয়ও হয়নি । আমি লাজুক টাইপের তো । যাইনি। লজ্জা লাগত খুব। যে দিন প্রকাশিত হল সে দিন গেলাম। গিয়ে কিছু বইপত্র নিয়ে আসলাম ওনার কাছ থেকে।
বিবিসিঃ মিঃ হুমায়ূন আহমেদ, সাহিত্যিক হিসাবে গত কয়েক দশক ধরে আপনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তুমুল জনপ্রিয়তা অনেক সময় বিড়ম্বনার কারণ হয় বলে শোনা যায়। আপনার ক্ষেত্রেও কি তাই হয়?
হুমায়ূন আহমেদঃ যে অর্থে বিড়ম্বনার কথা বলা হচ্ছে সে অর্থে আমি বিশেষ বিড়ম্বনার ভিতর যে পড়ি তা নয়। যদি বই মেলাতে যাই তখন পাঠকদের হুড়াহুড়িটা দেখে একটু ইয়ে লাগে- সামান্য ভয় ভয় লাগে। এছাড়া তো আমি নরমালি ঘোরাফেরা করি। আমি দোকানে যাই । বাজারে যাই। বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরি। কোন সমস্যা তো দেখি না আমি। যেটা হয় সাধারণত বই মেলাতেই হয়। বই মেলার বাইরে ধর, এগোরাতে গেলাম বাজার করতে। সেখানে দুই এক জনকে পাওয়া যায় তারা আমার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে চায় । এটা তো খুবই স্বাভাবিক। এটা তো বিড়ম্বনা ধরার কিছুই না । তাই না?
বিবিসিঃ আচ্ছা আপনি লেখালেখি থেকে অবসর নেবার কথা কি কখনো ভেবেছেন?
হুমায়ূন আহমেদঃ যখন খুব লেখালেখির চাপ যায় যেমন ধর, বই মেলার সামনে বা ঈদ সংখ্যার সামনে খুবই যখন চাপের ভিতর থাকি তখন দেখা গেল শেষ হয় যে দিন সে দিন মনে হয় এখন থেকে আমি অবসরে । আর লেখালেখির ভিতরে নাই। বাকি সময়টা আরামে থাকব, সিনেমা দেখব, গল্পের বই পড়ব। সে দিন মনে হয় । তারপরের দিন মনে হয় । কিন্তু ২য় দিন থেকে আবার মনে হয় আমার যেন কিছুই করার নেই । আমি মারা যাচ্ছি। এক্ষুনি বই/ কিছু একটা লেখা শুরু করতে হবে। লেখা শুরু করি । সঙ্গে সঙ্গে একটা স্বস্তি ফিরে আসে। হ্যা, আমি অবসর নিব। আমি ঠিক করেছি অবসর নিব। মৃত্যূর ঘন্টা খানেক আগে অবসর নিব। তার আগে নিব না। আমি চাই মৃত্যুর ১ ঘন্টা বা ২ ঘন্টা আগে আমি যেন এক লাইন বাংলা গদ্য লিখে যেতে পারি।