সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১৮, ২০১০
বিবিসি সাক্ষাৎকার — আগস্ট, ২০১১
হুমায়ুন আহমেদ ২০১১ সালের আগস্ট মাসে বিবিসি- বাংলায় একটি সাক্ষাতকার দেন। বিবিসি-র পক্ষে হুমায়ুন আহমেদের সাথে কথা বলেছেন অর্চি অতন্দ্রিলা। সাক্ষাতকারটি বিবিসি-র ওয়েব সাইট থেকে নেওয়া।
বিবিসিঃ আপনি গত চার দশক ধরে লেখালেখি করছেন। এ লেখালেখির শুরুটা কিভাবে হলো?
হুমায়ূন আহমেদঃ বাংলাদেশে আর ১০ টা মানুষ যে ভাবে লেখালেখি শুরু করে আমি একই ভাবেই শুরু করেছি। আলাদা কিছু নয়। তারা কি ভাবে শুরু করে? প্রথমে তারপরে স্কুল ম্যাগাজিনে লেখে, তারপর কবিতা লেখে তারপর পত্রপত্রিকায় পাঠাবার চেষ্টা করে। তারা যে ভাবে শুরু করেছে আমিও সেই ভাবেই শুরু করেছি। আলাদা কিছু নয়।
বিবিসিঃ আচ্ছা, মিঃ আহমেদ, আপনার পড়াশোনার বিষয় ছিল রসায়ন। সাধারণত মনে করা হয় এটা সাহিত্যের বিপরীতে। কিন্তু অধ্যাপনা ছেড়ে লেখার আগ্রহটা কি ভাবে তৈরী হলো?
হুমায়ূন আহমেদঃ সাধারণত মনে করা হয় এটা সাহিত্যের বিপরীতে। আসলেই কি তাই? যদি সাহিত্যের পক্ষে বা সাহিত্যের স্রোতে যে সাবজেক্টগুলো আছে সেগুলো কী? তাহলে বাংলা বা ইংরেজি সাহিত্য? যদি সেটা হয়ে থাকে তাহলে আমার প্রশ্ন থাকবে প্রতি বছর যে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী বাংলা বা ইংরেজিতে পাস করে বের হচ্ছে তাদের মধ্যে কয় জন লেখালেখি করছে? কে কি পড়ছে সেটার সাথে লেখালেখির কোন সম্পর্ক আছে বলে আমি মনে করি না।
বিবিসিঃ সাহিত্যের সাথে সাথে নাটক এবং সিনেমা পরিচালনায় আপনি কি ভাবে আসলেন?
হুমায়ূন আহমেদঃ হঠাৎ করেই আসি বলা যেতে পারে। আমি দেখলাম, আমার কিছু গল্প নিয়ে ওরা বাংলাদেশ টেলিভিশন নাটক তৈরী করেছে। নাটকগুলি দেখে আমি ভাবলাম, আমি নিজেই যদি নাটক তৈরী করতে পারতাম তাহলে কি ওদের চেয়ে ভাল হত না মন্দ হত? আমি নতুন কিছু কি করতে পারতাম? ঐ আগ্রহ থেকেই আমি নাটক তৈরী শুরু করি। আর সিনেমা তৈরীর পেছনে মূল কারণটা হচ্ছে – এতো বড় একটা মুক্তি যুদ্ধ হয়ে গেছে আমাদের দেশে । কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তেমন কোন ভাল ছবি তৈরী হয়নি। আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে একটা ভাল ছবি হওয়া দরকার। এই থেকেই আগুণের পরশমণি ছবিটা বানিয়েছি। নট নেসেস্যারি যে বিশাল কিছু হয়ে গেছে। কিন্তু চেষ্টাটা ছিল আর কি।
বিবিসিঃ আপনার লেখা অনেক চরিত্র মানুষকে কাদিয়েছে, হাসিয়েছে। আপনি নিজে কেঁদেছেন কোন চরিত্রের জন্য?
হুমায়ূন আহমেদঃ আমি যখন লেখালেখি করি তখন কোন একটা চরিত্র খুব ভয়াববহ কষ্ট আর দুঃখের মধ্যে পড়ে যায় তখন নিজের অজান্তেই দেখি আমার চোখে পানি আসে। কাজেই কোন বিশেষ চরিত্র নয় সব চরিত্রের জন্যই আমার চোখে পানি আসে। আর আমি তো অনেক হিউমার পছন্দ করি। যখন আমি হিউমারগুলো লিখি আমি শিওর যে তখন আমার আশেপাশে কেউ থাকলে তারা দেখবে যে আমার ঠোটের কোণায় মুচকি হাসি দেখতে পাবে তারা। —
বিবিসিঃ আপনার নাটক কোথাও কেউ নেই –তে বাকের ভাইয়ের মৃত্যু ঠেকাতে মানুষ যখন প্রতিবাদ শুরু করল মানুষের আবেগের দিকে তাকিয়ে একবারও কি বাকের ভাইকে বাচিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়েছিল?
হুমায়ূন আহমেদঃ এই নাটকের ২টি ভার্সন ছিল শেষে। একটি হচ্ছে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়েছি আরেকটি হচ্ছে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়নি। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়নি আমার খুব প্রিয় ভার্সন ছিল। কিন্তু বিটিভি শেষ পর্যন্ত ঠিক করে যেটায় ফাঁসি হয়েছে ঐটাই প্রচার করার ।
বিবিসিঃ কাল্পনিক চরিত্র বাকের ভাইয়ের সাথে মানুষের এমন একাত্ততা এনিয়ে আপনি কি ভাবছিলেন?
হুমায়ূন আহমেদঃ আমি খুবই অবাক হচ্ছিলাম । কত রকম মানুষের ফাসি হয়ে যায়, মানুষ মারা যায় রাস্তার পাশে, নির্দোষ মানুষকে ফাসিতে ঝুলিয়ে দেয়। এটা নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। এটা একটা চরিত্র, একটা কাল্পনিক চরিত্র। তার ফাসি হচ্ছে এটা নিয়ে যে এতো মাতামাতি এটা আমাকে খুব বড় রকমের ধাক্কা দিয়েছিল এই টুকু বলতে পারি । শুধু তাই নয়। মৃত্যুতে শেষ হয়ে যায়নি। তারপর শুরু হল কুলখানি। আজ অমুক জায়গায় বাকের ভাইয়ের কুলখানি। কাল অমুক জায়গায় বাকের ভাইয়ের কুলখানি। পরশুদিন বাকের ভাইয়ের জন্য মিলাদ মাহফিল। আমি এই রকম বিস্ময়কর ঘটনা ভবিষ্যতে দেখব তা মনে হয় না।
বিবিসিঃ আচ্ছা মিঃ আহমেদ, আপনার কোন কালল্পনিক চরিত্র নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হলে বহুব্রীহি নাটকের কাজের ছেলে সৈয়দ বংশ হওয়া বা একজন ডাক্তারের চরিত্র বোকা ধরণের হওয়া নিয়ে আপনার পাঠকের রসবোধ নিয়ে কি বিশেষ কিছু মনে হয়?
হুমায়ূন আহমেদঃ তখন মনে হয় জাতি হিসাবে আমরা খুব সিরিয়াস। প্রতি দিনের ঘটনায় যে একটা ফানি পাঠ আছে এটা আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। আমরা সিরিয়াস পাঠের দিকে তাকাই। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের মানুষ তো খুবই রসিক বলে আমি জানি। ওরা এই রসটা ধরতে পারে না কেন এটা নিযে আমি খুব আপসেট হই বলা যেতে পারে। তবে বেশী পাত্তা দিই না।
বিবিসিঃ আচ্ছা , আপনার উপন্যাসের একটা জনপ্রিয় চরিত্র হিমু। এটা কি নিছক কাল্পনিক না এর ভেতর আপনি আপনার পরিচিত কাউকে তুলে ধরেছেন?