আর ডন বলেছে :
আমার জন্মের বহু আগে থেকেই ক্রিকেট খেলা চলেছিল, আমার মৃত্যুর বহু শতাব্দী পরও খেলা চলবে। ঠিক যেভাবে একজন পিয়ানোবাদক বিঠোফেনের রচনাবলি ব্যাখ্যা করে, সেইভাবেই আমার বোধ-বুদ্ধি-ক্ষমতা অনুসারে ক্রিকেটের চরিত্রকে জনসাধারণের কাছে ব্যাখ্যা করার সুযোগ খেলার জীবনে পেয়েছিলাম।
…ভবিষ্যতে যে-মানুষেরা আমাদের ভাগ্যকে পথ দেখিয়ে দিয়ে যাবে, তাদের দরকার হবে সাহস, উদ্যম এবং শান্ত বিচারবোধ। তাদের সজাগ থাকতে হবে, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে।
সন্দেহ নেই, ক্রিকেটের আইন এবং এই খেলার পরিচালন পদ্ধতি বিশ্বের কাছে এক বিরাট দৃষ্টান্ত। এই উত্তরাধিকারটি সম্পর্কে আমাদের সকলের গর্ববোধ করা উচিত…
এবং ক্রিকেট গর্ববোধ করে তার ডনের জন্য। বিশ্বের কাছে সাহস, উদ্যম এবং শান্ত বিচারবোধের বিরাট দৃষ্টান্ত ক্রিকেটের ডন।
২১. ৯০ বছর ডন
১৯৯৮-এর ২৭ আগস্ট ডন পূর্ণ করল ৯০ বছর বয়স (জন্ম ২৭ আগস্ট, ১৯০৮)। হৃৎপিন্ডের অবস্থা ভালো নয়, দু-পায়ে আগের মতো জোরও নেই। ৬৫ বছর সুখে-দুখে একসঙ্গে কাটিয়েছেন যার সঙ্গে, স্ত্রী জেসি এগারো মাস আগে মারা গেছে ক্যান্সারে। সেইসঙ্গেই ডনের প্রাণশক্তির একটা বড়ো অংশও হারিয়ে গেছে। জেসি ছিল তার অনুপ্রেরণা; তার পরামর্শদাত্রী; তার গহন চিন্তার শরিক; তার আত্মার দোসর; তার সব কিছু। ৭০ বছর ধরে বিশাল খ্যাতির অধিকারী ডনের সঙ্গে বিপুল-সংখ্যক মানুষের পরিচয় ঘটেছে বটে কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধুসংখ্যা খুব স্বল্পই, তাদেরই একজন ছিল জেসি। স্ত্রী মারা যাবার পর এক বিশাল শূন্যতা তাকে গ্রাস করলেও, শরীর অশক্ত হয়ে পড়লেও ডনের চিন্তাক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি অটুট রয়ে গেছে ২০-৩০ বছর আগের মতোই। ডনের ৯০তম জন্মদিনটি ছিল স্মৃতির ভারে বিষণ্ণ একটি দিন। গতবছর স্বামীর ৮৯-তম জন্মদিনে জেসি অ্যাডিলেডের কেনসিংটন পার্ক অঞ্চলে তাদের হোল্ডেন স্ট্রিটের বাড়ির দোতলা থেকে নেমে এসেছিল শেষ বারের মতো ডনের জন্মদিন পালন করতে। শেষজীবনে জেসির লক্ষ্য ছিল তিনটি সাধ পূরণ করা— ৩০ এপ্রিল তাদের ৬৫তম বিবাহবার্ষিকী পালন, ১১ জুন তার ৮৮তম জন্মদিন পালন এবং ২৭ আগস্ট স্বামীর ৮৯তম জন্মদিন পালন। জেসি মারা যায় ১৪ সেপ্টেম্বর।
তবে তার বিষণ্ণ অস্তিত্ব ভেদ করে এক উজ্জ্বল আলোর রেখা ডনের জীবনকে বিদ্ধ করে—৫৯ বছর বয়সি পুত্র জনের সঙ্গে আবার তার মিলন। বাবার খ্যাতির বোঝা বহন করতে করতে ক্লান্ত, সংবাদমাধ্যমের অবিরাম কৌতূহলী জিজ্ঞাসায় অতিষ্ঠ হয়ে জন ২৬ বছর আগে বাবার জীবন ঢেকে-দেওয়া বিপুল খ্যাতির ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নামের পদবি অ্যাফিডেট দ্বারা বদলে ব্র্যাডসেন করে নেয়। পরিবার থেকে আলাদা হয়ে গেলেও জনের সঙ্গে বাবা-মা-র যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ থাকে। ছেলে পদবি বদল করায় ডন আঘাত পেলেও তাকে দোষ দেয়নি, কারণ সেজানে পাবলিসিটি নামক অভিশাপ ছোবল দিলে কী বিষযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।
লেডি ব্র্যাডম্যানের দীর্ঘ অসুস্থতা এবং মৃত্যুই বাবা ও ছেলের মধ্যে মিলন ঘটায়, হোল্ডেন স্ট্রিটের বাড়িতে জেসি যখন মৃত্যুপথযাত্রী তখন জন মায়ের শয্যাপাশে বহু রাত জেগে কাটিয়েছে, মায়ের মৃত্যুর পর তার জন্য শোকস্মরণ সভার আয়োজন করেছে সুচারু ও শোভনভাবে, এ সবই ডনকে গভীর নাড়া দিয়ে যায়। অ্যাডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ে জন আইনের অধ্যাপক। প্রতিদিন কাজের পর রাত্রে সেনিয়ম করে এখন নি:সঙ্গ বাবার সঙ্গে কথা বলে। ডনের ৯০তম জন্মদিনে অ্যাডিলেড কনভেনশন সেন্টারে ১১০০ লোক ডনের সম্মানে আয়োজিত ডিনারে যোগ দেয়। এজন্য মাথাপিছু তাদের দক্ষিণা দিতে হয় ১২৫ অস্ট্রেলীয় ডলার (৩১২৫ টাকা প্রায়)। স্টেট লাইব্রেরি অফ সাউথ অস্ট্রেলিয়ায় ব্র্যাডম্যান সংগ্রহশালার রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য তহবিল সংগ্রহ ছিল এই ভোজসভার উদ্দেশ্য। তারা যখন ভোজসভায় ডনের উদ্দেশ্যে পানপাত্র তুলে শ্রদ্ধা নিবেদন করছিল ঠিক তখনই ডন হোল্ডেন স্ট্রিটের বাড়িতে ছেলে (জন), মেয়ে (৫৭ বছরের শার্লি) ও নাতি-নাতনি (জনের ছেলে ১৭ বছরের টম ও মেয়ে ১৯ বছরের গ্রেটা-র সঙ্গে নিভৃতে জন্মদিন পালন করছিল।
৯০তম জন্মদিনে ডন শুধু দুজন লোককে তার সঙ্গে এক ঘণ্টার জন্য সাক্ষাতের অনুমতি দিয়েছিল। ভারতের শচীন তেণ্ডুলকর ও অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়ার্ন ছিল সেই দুই সৌভাগ্যবান। এই প্রথম দুজনে মুখোমুখি হল ডনের। চেন্নাইয়ে ভারতীয় ক্রিকেট দলের কন্ডিশনিং ক্যাম্প থেকে তেণ্ডুলকর এই বিরল সৌভাগ্যলাভের জন্য অ্যাডিলেডে উড়ে যায়। ডনের সামনে সেপ্রচন্ড নার্ভাস বোধ করেছিল, কিন্তু অচিরেই সেআশ্বস্ত হয় যখন সেজানল— ডন বর্তমানের ক্রিকেটারদের অনুরাগী, সীমিত ওভারের খেলা ডন নিয়মিত দেখে এবং ক্রিকেট সম্পর্কে সাবেকপন্থীদের মতো নাক সিঁটকানো ভাব নেই, ডনের দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক ও প্রগতিশীল। তেণ্ডুলকর জানতে চেয়েছিল, ম্যাচ খেলার জন্য ডন কী প্রস্তুতি নিত? ডন বলে সকাল সাতটা থেকে দশটা পর্যন্ত অফিসে কাজ করে, ম্যাচ খেলে ফিরে এসে আবার সেকাজ করতে যেত। তখন ক্রিকেটাররা সম্পূর্ণতই ছিল অ্যামেচার। ভোজসভায় ব্র্যাডম্যানের ছবি, পেইন্টিং, আবক্ষমূর্তি, ব্যাট এবং অন্যান্য দ্রব্যের নিলাম হয়, তাতে সংগৃহীত হয় প্রায় ১৯ লক্ষ টাকা। এর মধ্যে আছে এক লক্ষ টাকায় তেণ্ডুলকর-ক্রীত ব্র্যাডম্যানের একটি স্বাক্ষরিত ছবি—মেলবোর্নে তার টেস্টিমোনিয়াল ম্যাচে ১৯৪৮ ডিসেম্বরে ব্যাট করতে যাচ্ছে। ডন জীবনের শেষ ও ১১৭তম শতরানটি এই ম্যাচেই করে। ডনের সঙ্গে তেণ্ডুলকরের একটি ছবি মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব নিলামে কিনে নেয় সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকায়।