ডন কখনো ট্রাম্পারকে খেলতে দেখেনি। ট্রাম্পারের আর ব্র্যাডম্যানের যুগের যোগসূত্র হবস। এই সময়ের মধ্যে পিচ এবং বোলিং টেকনিক বদলেছে, ফিল্ড সাজানোতেও পরিবর্তন ঘটেছে। তা ছাড়া ট্রাম্পার ও হবস ছিলেন ওপেনিং ব্যাটসম্যান, ডন নামত তিন নম্বরে। তর্কের সময় সাধারণত এই কথাটা ওঠে যে, হবস ও ট্রাম্পার আরও ‘সম্পূর্ণ’ ব্যাটসম্যান। ডনের থেকে তাদের স্ট্রোকে পালিশ আরও বেশি। তবে সবাই স্বীকার করেন ডনই বৃহত্তম রান সংগ্রাহক। ওর উচ্চ রানের ইনিংসগুলি এমনই ও প্রায়শ ভয়ংকরভাবে গড়ে উঠত যে একসময় নেভিল কার্ডাস লিখেছিলেন :
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওর সমগ্র খেলার জীবনে, যদি ম্যাচ খেলার আগে ওকে কিনে নেওয়ার বা আপোশ করার কোনো আইনানুগ উপায় থাকত তাহলে অধিকাংশ বোলারই ওকে কিনে ফেলত বা ব্যাট করবে না এই শর্তে ১০০ রান উপহার দিত।
দুঃখের কথা, ডন যন্ত্রের মতো রান তুলত এই ধারণাটাই বেশি চালু রয়ে গেছে। বিপুল হারে রান সেঅবশ্যই উৎপাদন করেছে, কিন্তু রানগুলির পিছনে ছিল কল্পনা, চিন্তা ও দুঃসাহস; এটা অনেকেই মনে রাখে না।
ডন ক্রিকেট ব্যাট তুলে রাখার পর থেকেই মাঠে মাঠে দর্শকসংখ্যা হ্রাস পায়। দর্শনির অঙ্ক কমে যায়। তারপর ইংল্যাণ্ডে যত অস্ট্রেলীয় দল সফরে গেছে, কেউ আর ভক্তবৃন্দের সেই পরিমাণ চিঠি পায়নি— ডন ও তার দল যত পেয়েছিল।
গ্রামের গরিব ঘরের ছেলে। কোনোরকম সুযোগ বা সুবিধা নিয়ে ডন ক্রিকেটে আসেনি। নিজেই খেলা শিখেছে, একাকী। কিন্তু ক্রিকেটে সেনিয়ে আসে তোলপাড়-করা চাঞ্চল্য,প্রবল প্রেরণা আর একাগ্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা। সফরে হোটেলের ঘরে টাইপরাইটার নিয়ে বসে সেএক-এক বারে ষাটটি চিঠির জবাব দিত।
ইংল্যাণ্ডে ১৯৪৮-এর সফরে এক ক্রিকেট ব্যাটপ্রস্তুতকারী কয়েক হাজার ব্যাটে সই দেওয়ার জন্য ডনের সঙ্গে চুক্তি করে। প্রস্তুতকারী এজন্য কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে ধরে নিয়েছিল। একদিন ভোরে ডন ব্যাট তৈরির কারখানায় হাজির হয়ে, গা থেকে কোটটি খুলে, ব্যাট নিয়ে বসল। মাঝে চা খাওয়ার জন্য থামা ছাড়া, ডন সেইদিনই কাজটা শেষ করে দেয়।
বলা হয় ডন নির্দয়ভাবে খেলত। কঠিনভাবেই ডন খেলেছে, কিন্তু হীনতা কখনো প্রশ্রয় পায়নি। বলা হত ডন অসামাজিক। ল্যাঙ্কাশায়ার সম্পাদক তাকে ক্লাবের সদস্যপদ দিয়ে যে-চিঠি লেখেন তাতে বলা হয় :
আমার কমিটি একথাটাও নথিভুক্ত করে রাখতে চায় যে, আপনার ব্যক্তিগত মাধুর্য, সৌজন্য, প্রীতিপূর্ণ সখ্যতা, সম্পূর্ণ দক্ষতা ও বিনয়গুণেই আজ ক্রিকেট এত প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।
ডনের মনের মধ্যে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার সন্দেহ নেই। কিন্তু বহু খেলোয়াড় তাকে বন্ধু হিসেবেই পেয়েছে। ১৯৫২-৫৩-তে জ্যাক চিথামের দক্ষিণ আফ্রিকা দল যখন অস্ট্রেলিয়া সফরে আসে ডন তাদের কাঁচা খেলোয়াড়দের নেটে নিয়ে গিয়ে, কতকগুলো স্ট্রোক কীভাবে করতে হয় দেখিয়ে দিয়েছিল। বহু সময় ডন চিঠি লিখে খেলোয়াড়দের ত্রুটি জানিয়ে দিত, যাতে তাদের সাহায্য হয়। ১৯৪৬-৪৭ অস্ট্রেলিয়া সফরে ডেনিস কম্পটনকে তার কতকগুলো ত্রুটি দেখিয়ে দিয়েছিল। অথচ তখন দ্বিতীয় টেস্ট চলছে এবং ডন প্রতিপক্ষ অধিনায়ক। অমরনাথ বলেছিলেন :
ওঁর বিরুদ্ধে খেলতে ভালোবাসি এবং আমার সব খেলোয়াড়দেরও এই অভিমত কারণ উনি বিরাট খেলোয়াড় ও আদ্যন্ত ভদ্রলোক। প্রায়ই খেলার পর ব্র্যাডম্যান আসতেন এবং ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিংয়ে কী কী ত্রুটি ঘটছে এবং কীভাবে সেগুলো শোধরানো যায় আমাদের খেলোয়াড়দের তা বলতেন।
ডন ক্রিকেটকে ভালোবাসে। খেলা ফেলে ক্রিকেট ভাঙিয়ে সেটাকার পিছনে কখনো ছোটেনি। ১৯৩৬-এ তাকে টোপ দেওয়া হয় টেস্ট ম্যাচ খেলার বদলে যদি রিপোর্ট লেখে তাহলে সেহাজার পাউণ্ড পাবে। ডন প্রত্যাখ্যান করেছিল। ১৯৩৬-এ মরসুমশেষে তার কাছে প্রস্তাব আসে, নিউজিল্যাণ্ডে ক্রিকেট সম্পর্কে দিনে পনেরো মিনিটের দুটি বক্তৃতা যদি দেয়, তাহলে সপ্তাহে ১০০ পাউণ্ড ও যাবতীয় খরচখরচা পাবে। ডন যায়নি। দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে রিপোর্ট পাঠানোর জন্য সপ্তাহে এক হাজার পাউণ্ডের প্রস্তাবেও ডন সাড়া দেয়নি। ১৯৪৮-এ ইংল্যাণ্ডের সংবাদপত্রগুলি আরও বেশি টাকার প্রস্তাব দিয়েছিল, ডন খেলার জন্য তাও অগ্রাহ্য করেছিল।
বাওরালের শৈশব থেকে অনেক পথ পেরিয়ে এসেছে অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন অধিনায়ক স্যার ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যান। অস্ট্রেলীয় সংবাদপত্র ‘ক্যানবেরা টাইমস’ ১৯৪৮-এ ডনের অবসর নেওয়ার সময় যে-সম্পাদকীয় প্রকাশ করে তা থেকে উদ্ধৃত করে বলা যায় :
এই সুদীর্ঘ সময়কালে তিনি লক্ষ লক্ষ কন্ঠ থেকে উল্লাসধ্বনি নি:সৃত করিয়েছেন এবং কোনো ধ্বনিতেই হিংস্রতা বা অসদিচ্ছা জড়িয়ে ছিল না। যদি হিসাব সম্ভব হয় তাহলে দেখা যাবে হিটলারের দাবিকৃত বা সংগঠিত যত ধ্বনি উত্থিত হয়েছে, স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাসধ্বনি ততটাই পেয়েছেন ব্র্যাডম্যান। হিংস্রতার মানবটি নিজের ধ্বংস নিজ হাতেই করেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেছে, দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছে এবং এখনও মারা যাচ্ছে এবং তার কাজের জন্য কষ্টভোগ করছে।
কিন্তু এমন কোনো নারী, পুরুষ বা শিশু নেই যে ব্র্যাডম্যানের খেলার জীবন থেকে সহানুভূতি ও প্রেরণা ছাড়া আর কোনো ক্লেশ পেয়েছে। বিশ্ব-ইতিহাসে বরণীয়রূপে যাচাই হওয়ার এইটাই কষ্টিপাথর।