শুধু একটি ব্যাপার ডনের মানসিক শান্তি হরণ করেছে— তার মেয়ে শার্লি পঙ্গু। ছেলে জন বাবার মতোই ক্রিকেটে আগ্রহী এবং স্কুলে ভালোই নাম করে ব্যাটসম্যান হিসাবে। কিন্তু ১৪ বছর বয়সে হঠাৎ সেআক্রান্ত হল পোলিওয়। কোনো সান্ত্বনাই ডনকে কেউ তখন দিতে পারেনি।
নির্বাচকের পদ ডন ছেড়ে দিল। তার কথা : ‘জনকে আমায় এখন সময় দিতেই হবে; সুতরাং দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকার মতো কাজ আমি নিতে পারব না। আমার পরিবারের, ক্রিকেটের এবং নিজের প্রতি কর্তব্য পালন করতে হলে নির্বাচকের পদটি আমার অন্য কাউকে ছেড়ে দেওয়া উচিত।’
কিন্তু এক বছরের মধ্যেই অকল্পনীয় ব্যাপার ঘটল। জন সুস্থ হয়ে উঠেছে। পরের বছরই সেক্রিকেট, সাঁতার এবং দৌড় শুরু করল। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮-র মধ্যে স্প্রিন্ট এবং হার্ডলসে অস্ট্রেলীয় স্কুল ও কলেজের কয়েকটি নতুন রেকর্ডও করল। ১৯৫৯-এ কুড়ি বছর বয়সে জন প্রথম শতরান করে আন্তঃকলেজ ম্যাচে। তার প্রত্যাবর্তন তার বাবার থেকেও বিস্ময়কর।
ডন আবার ফিরে গেল নির্বাচকপদে। কিন্তু স্বাস্থ্য আর পুরোপুরি ফিরল না। ১৯৫৪-য় সেস্টক এক্সচেঞ্জ থেকে পদত্যাগ করে। তখন সেবলে, ‘গত তিরিশ বছর ধরে শরীর ও মনে আমার যে ধকল ও টানাপোড়েন গেছে তা একমাত্র আমার ঘনিষ্ঠরাই জানে। সহজ শান্ত জীবনযাপনের জন্য ডাক্তারের নির্দেশে অবাক হবার কিছু নেই, এটা বিস্বাদকরও মনে হচ্ছে না। স্টক এক্সচেঞ্জের কাজের দায় নামিয়ে দিতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত।’ ডনের অন্যান্য বিবৃতির মতো এতেও অনেক অকথিত বস্তু রয়ে গেল।
অনেকের কাছে মনে হতে পারে ডন সব কিছুই সহজে পেয়েছে। তার খেলার প্রতিভাই তাকে যশ, সম্মান ও বিত্ত এনে দিয়েছে।
ক্রিকেটই যে তাকে জীবনের অন্যান্য দিকের পথ খুলে দিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রত্যেকটিতে সফল হওয়ার জন্য তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। ভুললে চলবে না, ছুতোরের ছেলেটিকে শিক্ষিত হয়ে ওঠার জন্য একা একাই বই পড়ে রুচি ও জ্ঞান আহরণ করতে হয়েছে। ‘গেঁয়ো ক্রিকেটার’ বলে একদা তাকে হেনস্থা সহ্য করতে হয়েছে। রোগ ও ভগ্নস্বাস্থ্য এবং দুঃখদায়ক পারিবারিক ঘটনার সঙ্গে তাকে লড়াই করতে হয়েছে। যখন তার চাকুরিদাতা দেউলিয়া হয়ে গেল তখন নিজের ব্যাবসা প্রচন্ড পরিশ্রমে সেগড়ে তোলে।
ডনের ক্রিকেট লক্ষ লক্ষ মানুষের আনন্দের কারণ হয়েছে বটে, কিন্তু তা শুষে নেয় তার দেহশক্তির ভান্ডার। তবু সারাজীবন ডন মাথা উঁচিয়ে চলেছে—কোনো রাখঢাক নেই, আত্মমর্যাদায় দৃপ্ত।
২০. প্রবাদ এবং মানুষটি
ক্রিকেটের ইতিহাসে কোথায় কোন ক্রিকেটারের স্থান হবে, তাই নিয়ে তর্ক চলবে যতদিন ক্রিকেট বেঁচে থাকবে।
ডনের স্থান কোথায় হবে?
যেকোনো ব্যাটসম্যানের থেকে সেবেশি প্রথম শ্রেণির দ্বিশত ও ত্রিশত রান করেছে।
একদা সর্বোচ্চ রান ছিল তারই—অপরাজিত ৪৫২। টেস্ট ম্যাচের প্রথম দিনে লাঞ্চের আগে শতরান করেছে, এক দিনে করেছে ৩০০ রান। পর পর ছয় ইনিংসে ছয়টি শতরান আছে তার।
টেস্ট ক্রিকেটে তার থেকে বেশি রান আছে অন্যের, কিন্তু গড় ৯৯.৯৪? ধারেকাছে কেউ নেই। টেস্টে আশি ইনিংসে ৬,৯৯৬ রান এবং দশ বার অপরাজিত থাকার সুবাদে এই গড়। মাত্র চার রান অর্থাৎ বাউণ্ডারিতে এক বার বল পাঠালেই তার টেস্ট গড় ১০০ হত। ওভালে তার শেষ টেস্ট ম্যাচে হোলিজের বলটি না ফসকিয়ে যদি কোনোভাবে বাউণ্ডারিতে পাঠাতে পারত…
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৩৩৮ ইনিংসে তার মোট রানসংখ্যা ২৮,০৬৭। ইনিংসপিছু গড় ৯৫.১৪ রান। এতে আছে ১১৭টি শতরান। ইংরেজ ছাড়া আর শুধু সোবার্সই মাত্র ডনের মোট রানসংখ্যা ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে।
সারাজীবনে ডনের রানসংগ্রহের গড় হার ঘণ্টায় ৪২-এরও বেশি। বহু ক্ষেত্রে হারটা ৬০ রানেরও বেশি। একটিতে সেঘণ্টায় গড়ে ৯৪.১ হারে রান তুলেছে।
ডন ছিল বিশ্বের দ্রুততম ফিল্ডারদের একজন। প্রচন্ডভাবে বলকে তাড়া করে ছুটত, শূন্যে ক্যাচ তুলে নিত, অবিশ্বাস্য গতিতে উইকেটে ফিরিয়ে দিত।
বিরাট এবং শ্রদ্ধেয় অধিনায়ক ছিল।
ইংল্যাণ্ড অধিনায়ক নর্মান ইয়ার্ডলি, ১৯৪৮-এ ডনের এক বিদায় সভায় ওঁর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার’। এই বিশেষণটিকে নিয়ে তর্কে প্রবৃত্ত হবে এমন লোকের সংখ্যা নিশ্চয়ই খুব কম। অনেকের মতে ডন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান। জ্যাক হবসের ভক্তরা দাবি করেন ভিজে উইকেটে ডনের ব্যাটিংক্ষমতা সীমাবদ্ধ। এজন্যই হবসের সঙ্গে তার তুলনা হতে পারে না। ডনের অনুগামীরা বলবেন, তাতে কী হয়েছে, শেষপর্যন্ত তো ডনই বেশি রান করেছে। ডনের টেস্ট গড় প্রায় ১০০, আর হবসের ৫৬.৯৪। তারা দেখাতে পারেন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হবস প্রতি ছয় ইনিংসে একটি শতরান করেছে, ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ডনের শতরান প্রতি তিন ইনিংসে।
অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টর ট্রাম্পারকে অনেকেই চিরকালের সেরা ব্যাটসম্যান বলে থাকেন। ডন-অনুগামীরা বলবেন, ট্রাম্পারের গড় মাত্র ৩৯.০৪ এবং নয়-বার উইকেটে গিয়ে একটি শতরান করেছেন।
বস্তুত এভাবে তুলনা করার কোনো সার্থকতা নেই। ট্রাম্পার খেলেছেন ১৮৯৪ থেকে ১৯১৪; হবস ১৯০৫ থেকে ১৯৩৪ আর ডন ১৯২৭ থেকে ১৯৪৮।