জাহাজে অস্ট্রেলিয়া রওনা হওয়ার আগে ডন চিঠি পেল ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রসচিব ফিলিপ নোয়েল বেকারের কাছ থেকে:
অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত আর কোনো দল এইরকম নিরবচ্ছিন্ন বিস্ময়কর ক্রিকেট সাফল্য লাভ করেনি। আপনার সাফল্য শুধু মাঠেই নয়। আর কোনো খেলায় কোনো সফরকারী দল আপনার দলের মতো জনপ্রিয় হয়নি, এত সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে পারেনি। যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া উভয়েই আপনার কাছে কৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ থাকল। আশা করি আপনি যা করেছেন সেজন্য নিশ্চয়ই গর্ববোধ করছেন।
বলা বাহুল্য, ডন মনের নিভৃতে গর্ববোধ করেছে।
১৯. অ্যারাইজ স্যার ডোনাল্ড
ডন যখন স্বদেশের পথে জাহাজে, তখনই অস্ট্রেলিয়ায় রটে যায়— ব্র্যাডম্যান রাজনীতিতে নামছে। জাহাজেই সেটেলিগ্রাম পেল, গুজবটাকি সত্যি?
অস্ট্রেলিয়ায় তখন এই গুজবটিই একমাত্র আলোচ্য ব্যাপার। কাগজে কাগজে প্রবন্ধ বেরোল, রেডিয়োতে আলোচিত হল, এমনকী অস্ট্রেলীয় পার্লামেন্টেও এই নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। যথারীতি ডনের কাছে তাড়া তাড়া চিঠি এল। কেউ বলছে, রাজনীতিতে নামো, একদিন প্রধানমন্ত্রী হবেই। কেউ লিখল, গত কুড়ি বছরে বিরাট নাম ও খ্যাতি অর্জন করেছ, রাজনীতিতে যেয়ো না। ওটা নোংরা ব্যাপার, দু-এক বছরের মধ্যেই ঘৃণিত হবে, অসম্মানের বোঝা মাথায় চাপবে।
সেই ল্যাঙ্কাশায়ার লিগের ব্যাপারটাই আবার ফিরে এল। এত যে ডামাডোল, ডন কিন্তু চুপ। যথারীতি নিজের মতামত নিজের মনেই রেখে দিল। রাজনীতিতে সেআসেনি।
ডনের জন্য মেলবোর্ন মাঠে বেনিফিট ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছে। এক দিকের অধিনায়ক সেনিজে, অন্য দিকের হ্যাসেট। ডন ১২৩ রান করে। যখন ৯৭-এ, জনস্টনের বল হুক করে মিড-অনে বল তোলে। ম্যাককুল ছুটে এসে বলটি হাতে পেয়েও ফেলে দেয়। চেষ্টা করলে কি ক্যাচটা লুফতে পারত না ম্যাককুল? ইচ্ছা করেই কি ফেলে দিল যেহেতু এটা ডনের বেনিফিট ম্যাচ এবং ৫০ হাজার দর্শক মাঠে এসেছে ডনের কাছ থেকে একটি শতরানের প্রত্যাশী হয়ে? হয়তো। হয়তো নয়। ম্যাচটি ‘টাই’ হয়েছিল।
এরপর এল ১৯৪৯-এর পয়লা জানুয়ারি। সবিস্ময়ে পৃথিবী জানল ডন ব্র্যাডম্যান নাইটহুড পাচ্ছে। প্রথম ক্রিকেটার, শুধুমাত্র খেলার জন্যই যাকে এই সম্মান দেওয়া হচ্ছে। ডনের আগে ও পরে কয়েক জন ক্রিকেটার ‘স্যার’ খেতাব পেয়েছেন; কিন্তু অন্য কারণে, শুধুই ক্রীড়া কৃতিত্বের জন্য নয়।
বছরের শেষ দিনটিতে ডন মেলবোর্ন মাঠে এসেছিল খেলা দেখতে। বহুলোক কাছে এসে অভিনন্দন জানায়। ডন জানে কীজন্য এই অভিনন্দন। কেননা নাইটহুড দেওয়া হবে এটা তাকে জানিয়ে রাখা হয়েছে। সেঅবাক হল, অন্য লোক তা জানল কী করে। সরকারিভাবে ঘোষিত হওয়ার আগে এটা জানিয়ে দেওয়া অশোভনতা। তাই ডন মাঠে সারা দুপুর শুধু না জানার ভান করে যায়। সন্ধ্যা থেকে সেপালিয়ে রইল এক বন্ধুর বাড়িতে। রীতি মান্য করায় ডনের আনুগত্য এমনই কঠোর যে সেখানেও সেমুখ খোলেনি। ঘড়িতে রাত বারোটা বাজার পর সেবন্ধুদের খবরটি দেয়। বাড়ি ফেরার পথে ডন খবরের কাগজ কিনে দেখে, তার নাম তালিকায় রয়েছে। ভোরে টেলিফোন এল। মিটাগং-এ বাপের বাড়ি থেকে তার স্ত্রী ফোন করে জানাল, রেডিয়োয় খবরটা শুনেছে।
অ্যাডিলেডে ফিরে এসে ডন অভিনন্দনের বন্যার মুখে পড়ল। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আর চিঠির স্রোত। এরই মধ্যে ডনের খুব ভালো লাগে অসম থেকে ৮ বছরের একটি ছেলের চিঠি। ডন অবাক হয়ে ভাবে, কত জনপ্রিয় সেহতে পেরেছে। গাঁয়ের ছেলে, কোথাও কোনো প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই, শুধুই নিজের কৃতিত্বে হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক; তারপর এই সম্মান! বস্তুত সামান্য থেকে অসামান্য হয়ে ওঠার প্রতীকরূপে ডনকে অস্ট্রেলিয়াবাসীরা বিবেচিত করে থাকে।
ইংল্যাণ্ডের কাগজে কচকচি শুরু হয়েছিল; স্যার ডন না স্যার ডোনাল্ড, কী বলা হবে? ডনের স্ত্রী অর্থাৎ নতুন লেডি ব্র্যাডম্যান জবাব দিয়ে দেয়, ‘স্যার ডোনাল্ড’। মেলবোর্নে পার্লামেন্ট ভবনে অস্ট্রেলীয় গভর্নর জেনারেলের কাছ থেকে ডন ‘নাইটহুড’ গ্রহণ করে।
ফেব্রুয়ারিতে কিপ্যাক্স ও ওল্ডফিল্ডের জন্য আয়োজিত টেস্টিমোনিয়াল ম্যাচ ডন খেলে সিডনিতে। ৬৫ মিনিটে ৫৩ রান করে তার মাঠকে শেষ অভিবাদন জানায়। অ্যাডিলেডে ফিরে এসে আর্থার রিচার্ডসনের টেস্টিমোনিয়াল হিসাবে চিহ্নিত ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচটিতে খেলে। বিল জনস্টনের বলে ৩০ রানে বোল্ড হওয়ার পর ফিল্ড করার সময় পা মুচকে যায়। ১৯৩৮-এ ওভালে এই পা-টিই জখম হয়েছিল। জীবনের শেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচটির শেষের প্রহরগুলি ডন ড্রেসিং রুমে বসে কাটাতে বাধ্য হয়।
খেলার আমন্ত্রণ ডনের কাছে এসেছে কিন্তু পরিষ্কারভাবে সেপ্রত্যাখ্যান করে দেয়। বার বার অবসর নেওয়া আর খেলতে নামা, যারা এই কাজ করে, ডনের ধারণা তারা শুধুই হাস্যকর হয়ে ওঠে। এখন থেকে সেতার শেয়ার দালালি ব্যবসায়েই মন দেবে। তবে হালকা মেজাজের, অ্যাডিলেড শেয়ার দালালদের বাৎসরিক ম্যাচের মতো খেলায় তার আপত্তি নেই।
এখন থেকে ডন তার শেয়ার দালালি ব্যবসায়েই ব্যস্ত থাকল। অ্যাডিলেডে এলেই আগন্তুকদের চোখে পড়ে ট্রামওয়ে টার্মিনালের কাছে ‘ডন ব্র্যাডম্যান অ্যাণ্ড কোং’ সাইনবোর্ডটি। অন্যান্য ব্যবসায়েও ডন আগ্রহী। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টরপদেও তাকে দেখা গেল। শরীর পোক্ত রাখার জন্য সপ্তাহান্তে এখন সেগলফ খেলে। বাড়িতে বিলিয়ার্ডস টেবিল পাতল এবং কয়েক জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে বিলিয়ার্ডস খেলে সন্ধ্যা কাটায়। ক্রিকেটে সেনির্বাচক, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এবং জাতীয় দলের।