মাঠে মহাশ্মশানের নৈ:শব্দ্য। স্বপ্নোত্থিতের মতো ডন স্টাম্পের দিকে তাকিয়ে; বিশ্বাস করতে পারছে না তার খেলোয়াড় জীবনের শেষ পরিণতি। শুধু একটি বার ব্যাট চালিয়ে বাউণ্ডারিতে বল পাঠালেই টেস্ট ক্রিকেটে ইনিংস পিছু গড় রান হত ১০০। মাত্র চারটি রান দরকার ছিল।
শেষ টেস্টে অস্ট্রেলিয়া জেতে ইনিংস ও ১৪৯ রানে। খেলাশেষে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হল ওভাল প্যাভিলিয়নের সামনে, তারা ডনকে দেখতে চায়। ডন বারান্দায় এসে দাঁড়াল। কিছু বলতে হবে।
আপনারা কাগজে যা-ই পড়ুন-না কেন, নিশ্চিত করেই বলছি এইটিই আমার শেষ টেস্ট ম্যাচ। এতে আমার ব্যক্তিগত অবদান এত কম, যার জন্য দুঃখবোধ করছি। এর দুটি কারণ— আমাকে দেওয়া অভিনন্দনের বিপুল দাক্ষিণ্য এবং দ্বিতীয়ত, আমাকে যে চমৎকার বলটি করা হয়েছিল।
ইংল্যাণ্ড অধিনায়ক নর্মান ইয়ার্ডলি বলল, ‘ডনকে গুড-বাই বলার সঙ্গে সঙ্গে সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারকেই আমরা বিদায় জানাচ্ছি।’
এরপর জনতা গেয়ে উঠল—‘ফর হি ইজ এ জলি গুড ফেলো।’
ডন ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিল, কিছু-একটা সেলুকোতে চাইছে।
ডন পর পর তিনটি ইনিংসে— জেন্টলমেন, সাউথ অফ ইংল্যাণ্ড ও লেভিসন গাওয়ারস একাদশের বিরুদ্ধে তিনটি শতরান করে সফর শেষ করে। সফর শেষ করবে অপরাজিত থেকে, যা কোনোদিন কেউ পারেনি। সিরিজে ৪-০ জয়ের পরও ডন প্রতিটি খেলা টেস্ট ম্যাচের গুরুত্ব দিয়ে খেলে।
ডন লর্ডসে জেন্টলমেন অফ ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ১৫০ করল। সফরে পূর্ণ ফল ২,০০০ রান। চার বার ইংল্যাণ্ড সফরে প্রতি বারই দু-হাজার রান, কোনো দেশের কেউ পারেনি। এই খেলার মধ্যেই ডনের জীবন ৪০ বছর অতিক্রম করে। খেলার শেষে দর্শকরা প্যাভিলিয়নের সামনে জড়ো হয়ে গান ধরে— ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।’ ডন মনে মনে তখন বলেছিল—যেভাবে খেলা উচিত বোধ হয় সেইভাবেই ক্রিকেট খেলেছি, নয়তো এই ভালোবাসা কেন পাব!
হেস্টিংসে সাউথ অফ ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ১৪৩। স্কারবরোয় শেষ খেলায় তিন ঘণ্টায় ১৫৩ করে বেডসারের বল হাটনের মাথার উপর তুলে দিয়ে ডন ছুটতে ছুটতে প্যাভিলিয়নে ফিরে আসে। ইংল্যাণ্ডের মাঠে ডনের শেষ নিষ্ক্রমণ। একটি যুগের প্রস্থান। চারটি সফরে ইংল্যাণ্ডে তার ১২০তম ইনিংসে ৯,৮৩৭ রান। ইংল্যাণ্ডের মাঠে ডন শেষ খেলায় শেষ ওভারটি নিজে বল করে। এরপর অবশ্য স্কটল্যাণ্ডের অ্যাবারডিনে একটি দ্বিতীয় শ্রেণির খেলায় ডন দেড় ঘণ্টায় ১২৩ রান করে।
ডন দারুণ খুশি। জীবনের সেরা বাসনা পূর্ণ হয়েছে। ইংল্যাণ্ড সফরে অপরাজিত অধিনায়ক থাকার মর্যাদা সেপেয়েছে। ৩১টি ম্যাচে ২৩ জয় (১৫টি ইনিংসে), ৮ অমীমাংসিত। টেস্ট বাদে কোনো দল ৩০০ রানের ইনিংস করতে পারেনি। টেস্ট খেলোয়াড় বাদে কেউ পারেনি তাদের বিরুদ্ধে শতরান করতে। সফরে অস্ট্রেলিয়া করেছে ১৫,১২০ রান, বিরুদ্ধে হয়েছে ১০,৯৩২ রান। সাত জন অস্ট্রেলীয় হাজার রান পূর্ণ করে। ২৭ রানের জন্য পারেনি লক্সটন। ডন সফরে করে ২,৪২৮ রান, ৮৯.৯২ গড় এবং ১১টি শতরান।
শুরু হল সম্মান বর্ষণ। ইয়র্কশায়ার, ল্যাঙ্কাশায়ার, হ্যামশায়ার ও অন্যান্য ক্লাব ডনকে আজীবন সাম্মানিক সদস্য করল। ইংরেজ নয় এমন একজনকে এই প্রথম ইয়র্কশায়ার এই সম্মান দিল। লণ্ডনের রবিবাসরীয় ‘দ্য পিপল’ সংবাদপত্র ডনের জন্য তহবিল খুলল। সব শ্রেণির মানুষ যাতে শ্রদ্ধা জানাতে পারে তাই দানের পরিমাণ বেঁধে দেওয়া হয় এক শিলিং। তারা বিরাট বিদায়-ভোজের ব্যবস্থা করল। তাতে এল ইংল্যাণ্ডের সাত জন প্রাক্তন ও নয় জন কাউন্টি অধিনায়ক। অতিথিসংখ্যা দুশো। তাদের মধ্যে অনেকেই মাঠে ডনের বিরোধিতা করেছে। দেখা গেল লিণ্ডওয়ালের পাশে বসে আছেন হ্যারল্ড লারউড!
তহবিলের অর্থে তৈরি বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক ‘ওয়ারউইক ভাস’-এর প্রতিকৃতি ব্রিটেনের ক্রিকেটপ্রেমীদের তরফ থেকে ডনকে উপহার দেওয়া হল এই সংবর্ধনা-ভোজে। নিরেট রুপোর তৈরি ২১ ইঞ্চি উচ্চ এই ভাস যার নকল, সেই আসলটি কিন্তু শ্বেতপাথরের এবং গোলাকৃতি। উচ্চতায় সাড়ে পাঁচ ফুট, ব্যাস ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে নির্মিত। স্যার উইলিয়াম হ্যামিলটন নেপলসে চতুর্থ ফার্দিনান্দের রাজদরবারে তৃতীয় জর্জের রাষ্ট্রদূত থাকাকালে ১৭৭০ সালে রোম থেকে ১২ মাইল দূরে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চালিয়ে এই ভাসটি পান। এর গাত্রে কতকগুলি অর্ধপশু-অর্ধমানব মুখ খোদাই করা। মুখের একটি নিখোঁজ। হ্যামিলটন ঠিক করেন তাঁর স্ত্রী লেডি হ্যামিলটনের মুখ সেখানে বসাবেন। এক ইটালির ভাস্করকে তিনি নিযুক্ত করেন। লোকটি রগচটা, ততোধিক লেডি হ্যামিলটনও; ফলে খিটিমিটি ঝগড়া দুজনের মধ্যে বেঁধে যায়। শোধ নেওয়ার জন্য ভাস্করটি লেডি হ্যামিলটনের সুন্দর মুখটি নিখুঁত খোদাই করে কান দুটি করে দেয় গাধার। অতঃপর গৃহশান্তি বজায় রাখতে হ্যামিলটন বাড়ি থেকে ভাসটি বিদায় করতে বাধ্য হন। তিনি মামাতো ভাই ওয়ারউইকের আর্ল-কে সেটি দান করেন।
তহবিলের যে-অর্থ ভাসটি তৈরির পরও রয়ে যায়, ডনের অনুরোধে ইংল্যাণ্ডের বিভিন্ন পার্কে ছোটোদের জন্য কংক্রিট ক্রিকেট পিচ তৈরির জন্য তা ব্যয়িত হয়।
এই সময় একটা ব্যাপার কাগজে সামান্য ঝড় তোলে। বামোরালে ষষ্ঠ জর্জ অস্ট্রেলীয় দলকে রাজপরিবারের সঙ্গে চা-পানের নিমন্ত্রণ করেন। কাগজে ছবি বেরোল ডন ইংল্যাণ্ডের রাজার সঙ্গে কথা বলছে ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে। হইচই পড়ে গেল ডনের অসৌজন্য ভঙ্গি নিয়ে। কাগজে চিঠি বেরোল। অপ্রতিভ ডন শুধু এইটুকু বলল, ‘এরকম ক্ষেত্রে লোকে হাত দুটো নিয়ে করে কী?’