স্টিকি উইকেটে সফল হওয়ার যাবতীয় টেকনিক্যাল প্রয়োজনই ব্র্যাডম্যানের ছিল। যথা, দ্রুত ফুটওয়ার্ক, সুদক্ষ ব্যাক-প্লে, বলের লাইনে এসে খেলা, দেরি করে ব্যাট চালনা, ওভার পিচ বলের কাছে পৌঁছোনোর এবং পেটানোর ক্ষমতা, বাকি যাবতীয় ফরোয়ার্ড খেলা ছাঁটাই করা এবং অসুবিধাজনক লেংথের বল থেকে ব্যাটকে সরিয়ে রাখা। এতৎসত্ত্বেও চক্ষু, মস্তিষ্ক ও পদদ্বয়ের মধ্যে অকল্পনীয় দ্রুততায় সমন্বয় ঘটাবার অধিকারী ব্র্যাডম্যান স্টিকি উইকেটে অসফল। রে রবিনসনের ধারণা, এর কারণ পা বা হাত যতটা নয় তার থেকেও বেশি মানসিকতা। যে-পিচে বল আপন খেয়ালখুশিমতো আচরণ করে, সেখানে ব্যাট করায় ব্র্যাডম্যানের তীব্র বিরাগ। দাপটে প্রভুত্ব করায় সেএতই অভ্যস্ত ছিল যে, উইকেটের বিদ্রোহ বা বাম্পারের চক্রান্ত তার ব্যাটিং থেকে কতৃত্ব হরণ করত। তাকে তখন মনে হত সেই অসুখী ম্যানেজিং ডিরেক্টর, বহু বছর যাকে লিমুজিনে অফিসে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে কিন্তু এখন সাইকেলে অফিসে যাচ্ছেন। ১৯২৮-এ ব্রিসবেনে তার প্রথম টেস্ট খেলার আগে পর্যন্ত ব্র্যাডম্যান স্টিকি উইকেট কখনো চোখে দেখেনি।
শুকনো উইকেটে এবং যখন সেতুঙ্গে, কোনো বোলারই ব্র্যাডম্যানকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। রান তোলার দ্রুতলয় সত্ত্বেও খুব কমই সেঅসুন্দরভাবে বল মাটি থেকে তুলে মেরেছে। ব্যাটসম্যানশিপের দাবাগ্নি সেজ্বালিয়েছে, জ্বালাতে গিয়ে নিজের হাত কখনও পোড়ায়নি। প্রত্যেক বোলার চেষ্টা করেছে মুহূর্তের জন্যও অন্তত ব্র্যাডম্যানকে খ্যাতিচ্যুত করতে। প্রথম রানটি বা দ্বিশত কি ত্রিশত সম্পূর্ণ করার রানটি পাওয়ার জন্য কেউ তাকে একটিও সহজ বল দেয়নি। সেইজন্য ব্র্যাডম্যানও কখনো কোনো ব্যাটসম্যানকে তার দাতব্যের পাত্র করতে উৎসুক হয়নি। দিনের পর দিন তাকে ব্যাট করে যেতে হয়েছে দূরান্ত থেকে আসা, সকাল থেকে লাইন-দেওয়া দর্শকদের মন ভরানোর জন্য। ইংল্যাণ্ড সফরকালে শারীরিক বা মানসিক অবসাদের জন্য যদি সেজানাত— খেলব না, তাহলে বহু কাউন্টি ক্লাব দেউলিয়া হওয়ার দিকে আরও কিছুটা এগিয়ে যেত। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে খেলতে হয়েছে, পরিস্থিতি দাসে পরিণত করেছিল প্রভুকেই। এ যুগের আর কোনো ক্রিকেটারই দাবি মেটাতে বা আশা পূরণ করতে ব্র্যাডম্যানের মতো বিবেকের ডাকে এতটা সাড়া দিয়েছে কি না সন্দেহ। শতরান করেও সেউইকেট ছুড়ে দিয়ে আসত না। দলকে জেতানোর মতো অবস্থায় পৌঁছে দেওয়ার বা পরাজয় থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব পালন ছাড়াও ছেলে, বুড়ো, রসিক ও অজ্ঞ সব রকমের দর্শককে মাতিয়ে রাখার কাজ তাকে করতে হত।
ব্র্যাডম্যান কঠিনভাবে খেলেছে ঠিকই কিন্তু নীচভাবে খেলেনি। আয়াস এবং প্রয়াস বাদ দিয়ে সেক্রিকেটকে ভাবতে পারেনি। প্রতিপক্ষকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে কিন্তু তাকে দাক্ষিণ্যে রাজি হয়নি। প্রবল বিরোধিতার সেকদাচ অবমাননা করেছে বা তার থেকে দূরে সরে গেছে কিন্তু নির্দয় হয়েছে অযোগ্য দুর্বলচিত্ততার প্রতি। ভালোবাসা যত-না পেয়েছে তার থেকেও বেশি আদায় করেছে শ্রদ্ধা। সহজে সেবন্ধু করে না, বন্ধুত্ব রক্ষার জন্যও নিজের পথ ছেড়ে বেপথে যায় না। অসামাজিক আখ্যা সেপেয়েছে তার কারণ, যেকোনো লোকের সঙ্গে দহরম-মহরম করায় তার রুচি কম। তার অ-জনপ্রিয়তার আংশিক কারণ তার প্রচন্ড ক্ষমতা এবং ওস্তাদি। তার সাফল্য সহজেই মানুষের দুর্বল রিপু ঈর্ষাকে জাগিয়ে তুলেছিল। ব্র্যাডম্যান তার সেরা সময় নি:সঙ্গ কাটিয়েছে। প্রতিভাই তাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল অন্যদের থেকে।
কঠোর এবং চতুর অধিনায়ক ব্র্যাডম্যানের করায়ত্ত ছিল প্রতিটি কূট চাল। চমকপ্রদ তৎপর ফিল্ডসম্যান, হরিণের মতো দ্রুতগতি, বাউণ্ডারি থেকে নির্ভুল নিক্ষেপে বল পৌঁছে দিত উইকেট-কিপারের হাতে। পরিহাসরসিক বক্তারূপে ক্রিকেটে তার জুড়ি খুঁজে পাওয়া ভার। সেআগেও যেমন এখনও তাই, অসাধারণ মানুষ। যতগুলি টেস্ট রেকর্ড এখনও তার নামে রয়েছে, একদা ততগুলি ব্যবসায় সংস্থার ডিরেক্টর ছিলেন স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান।
ব্র্যাডম্যান ১৯৭৪-এ লণ্ডনে আসে ১৩ বছর পর। প্রশ্নোত্তরে জানায়, ইংল্যাণ্ডে তার দেখা সেরা ব্যাটিং নটিংহামে ম্যাককেবের ২৩২, অস্ট্রেলিয়ায় দেখা সেরা ব্যাটিং মেলবোর্নে বিশ্ব একাদশের পক্ষে সোবার্সের ‘অবিশ্বাস্য’ ২৫৪। তার খেলার জীবনে সেরা বোলার বিল ও রিলি, ইংল্যাণ্ডের সেরা অ্যালেক বেডসার। নিজের সেরা ব্যাটিং? ১৯৩০-এ লর্ডসের ২৫৪ আর লিডসে একদিনে ৩০০ রান। আজকে এমন সুস্বাস্থ্য বজায় আছে কী করে?—‘‘গত ৬৫ বছর যাবৎ সু-জীবন যাপনে।’’ একটি নৈশভোজে বক্তৃতা দেওয়ার সময় ৬৫ বছরের ব্র্যাডম্যান এই কথাগুলি বলে :
আইনের অধীনে স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নুরেমবার্গে লর্ড বারকেট যা বলেছিলেন সেই সততা, আন্তরিকতা, বিশুদ্ধতা ও মানবিকতাই আমাদের চাই, নয়তো এই পিচ খেলার অযোগ্য হয়ে উঠবে।
ডন ব্র্যাডম্যান সারাজীবন আইন মেনে ‘ক্রিকেট’ খেলে গেছে। মাঠে এবং মাঠের বাইরে ‘অযোগ্য পিচ’ সেপ্রত্যাখ্যান করেছে। তার বিরাটত্বের পরিলেখ মাত্র এই বইয়ে আঁকতে চেষ্টা করেছি। মাঠে যত বড়ো ক্রিকেটার, মাঠের বাইরেও তত বড়ো চরিত্র। অতি সামান্য থেকে সংকল্প, নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণবলে অসামান্য হয়েছে। খেলার ও সামাজিক উভয় ক্ষেত্রে ডনের মতো সুদীর্ঘকাল এতখানি মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব কোনো খেলায় আর কেউ বোধ হয় বজায় রাখতে পারেনি। ওর জীবনকথা ওর খেলার মতোই অভিভূতকারী, প্রেরণাদায়ক এবং মানুষের ক্ষমতাকে নতুন সীমান্তের দিকে ঠেলে দিতে উত্তেজিত করায়। অনুভব করছি, ডনের সঙ্গে আমাদের এখনকার ছেলেমেয়েদের পরিচয় হওয়া দরকার। আর সেই উদ্দেশ্যেই কিশোরদের পড়ার জন্য এই বইটি লিখলাম।