লিডসে ওরা ডনকে জানে। কোনোভাবেই দ্বিতীয় ইনিংসে ওর শতরান করা কেউ বন্ধ করতে পারবে না। ওরা বন্যার মতো এল এবং বাউণ্ডারি লাইন ছাপিয়ে মাঠে উপচে পড়ল ডনের প্রতিশোধ নেওয়া দেখতে। আম্পায়ার দুজন ব্যর্থ হল দর্শকদের ঠেলে লাইনের ওপারে পাঠাতে। পুলিশও পারল না।
অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে ৩৮ রানে পিছিয়ে থাকার পর ইংল্যাণ্ড ৮ উইকেটে ৩৬৫ রান তুলে ইনিংস ছেড়ে দেয় ৪০৪ রান ৩৪৫ মিনিটে তুলে অস্ট্রেলিয়াকে ম্যাচ জেতার সুযোগ দিয়ে। চতুর্থ ইনিংসে চারশো রান! ইংল্যাণ্ডের মাঠে টেস্ট ম্যাচে এর আগে কোনো দল তুলতে পারেনি।
চতুর্থ দিনে ইংল্যাণ্ড চারশো রানে এগিয়ে, রাত্রে ডন ডায়েরিতে লিখল, ‘জেতার জন্য আমাদের ৪০০ রান তুলতে হবে এবং আমার ভয় হচ্ছে হয়তো আমরা হেরে যাব।’
দেখে মনে হচ্ছে উইকেটের দ্রুত অবনতি ঘটছে এবং দারুণ স্পিন ধরবে। ভারী রোলার চালিয়ে উইকেট ভেঙে দিলে অস্ট্রেলিয়া বিপদে পড়বে এই বিশ্বাসে খেলার শেষ দিনে পাঁচ মিনিট ব্যাট করে ইয়ার্ডলি ইনিংস ঘোষণা করে। এই ভারী রোলার ব্যবহারের সিদ্ধান্তটিই অস্ট্রেলিয়াকে সুবিধা করে দেয়। ভারী রোলার কখনোই উইকেট ভাঙে না। কেননা ক্রিকেট পিচ শক্ত হয় এবং সেটি খেটেখুটে তৈরি করা। মাটি সহজে আলগা হয় না। রোলারের ওজন নির্দিষ্ট এবং তার ভার পিচের উপর চারিয়ে থাকে। ভারী রোলারে পিচ তো ভাঙেই না বরং জমিকে চেপে বসিয়ে দিয়ে সহজ করে দেয় ব্যাটিংয়ের পক্ষে। ইয়ার্ডলির সিদ্ধান্ত যে কতটা ভুল, সেটা ম্যাচের ফলই বলে দিল। এর উপর, উইকেট ভালো হয়ে যাওয়া ছাড়াও স্পিন ধরল অতি মন্থরগতিতে। দলে লেকার ছাড়া খাঁটি স্পিন বোলারও কেউ ছিল না এবং ১৯৪৮-এ লেকার যথেষ্টই কাঁচা ছিল।
অস্ট্রেলিয়ার ৫৭ রানে হ্যাসেট ফিরে আসতেই ভিড় সরিয়ে পুলিশ ডনকে পথ করে দিল মাঠে নামার জন্য। উত্তাল অভিনন্দন মাঠে ভেঙে পড়ল।
ডন চটপট রান তোলার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মরিস এবং সেলাঞ্চের আগের আধ ঘণ্টায় তুলল ৬২ রান। ডনের যখন ৫০, পয়েন্টে ইয়ার্ডলিকে ক্যাচ দিয়ে অব্যাহতি পায়, ৫৯ রানে ক্যাচ দিয়েছিল স্লিপে, দু-বারই কম্পটনের বলে, এরপরই ক্র্যানস্টনকে বাউণ্ডারিতে হুক করেই ডন পাঁজর চেপে ধরে। আবার ফাইব্রোসাইটিস তাকে ধরেছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে খেলা শুরু করল। হুক করে আবার চার এবং আবার যন্ত্রণা! পোলার্ড তার বুকে মালিশ করে দিল, ইংল্যাণ্ডের একজন ছুটে গিয়ে জল আনল। মাঠের চারধারে তখন নিঝুমতা নেমে এসেছে। শুরু করল ডন আবার। তবে যতটা সম্ভব মরিসকে খেলতে সুযোগ দিয়ে, যন্ত্রণাটা কমার জন্য সময় নিল সেএবং ১৪৭ মিনিটে এইভাবেই সেশতরানে পৌঁছোল। এটি তার জীবনের ১১২তম এবং টেস্টের ২৯তম শতরান।
দ্বিতীয় উইকেটে মরিস (১৮২) ও ডন তুলল ৩০১ রান। নীল হার্ভে যখন বাউণ্ডারিতে বল পাঠিয়ে অস্ট্রেলিয়ার রান তিন উইকেটে ৪০৪ করল, ডনের রান তখন ১৭৩। অস্ট্রেলিয়া ৭ উইকেটে চতুর্থ টেস্ট ম্যাচ জিতল। এরপর ম্যাঞ্চেস্টারের ল্যাঙ্কাশায়ারের বিরুদ্ধে ডন ১৩৩ রানে অপরাজিত থাকে।
ওভালে পঞ্চম টেস্ট ম্যাচ। সফরের শেষ এবং ডনের জীবনেরও। অধিনায়ক হিসাবে ১৯৩৮-র প্রথম সফরে এই মাঠেই ডন নিষ্ঠুর এবং জঘন্যভাবে হেরেছিল। এই মাঠ থেকেই তাকে বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পায়ের গোছের হাড় ভাঙায়। এই মাঠেই ইংল্যাণ্ড বিশ্ব টেস্ট রেকর্ড করে এক ইনিংসে ৯০৩ রান। এ সবই দশ বছর আগের কথা।
টেস্ট শুরুর কয়েক দিন আগে লণ্ডনে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। উইকেট ভিজে বটে কিন্তু নির্জীব। অথচ প্রথম ব্যাট করে ইংল্যাণ্ড আউট হয়ে গেল ৫২ রানে। দুই অঙ্কের রান এক জনই মাত্র করে—লেন হাটন। ইনিংসে শেষ আউট হয় ৩০ রানে। লিণ্ডওয়ালের ছয় উইকেট ২০ রানে। নিজের দেশে এত কম রানে ইংল্যাণ্ড কখনো আউট হয়নি। ১৩০ মিনিটে ইনিংস শেষ।
অস্ট্রেলিয়ার ১১৭ রানে ডন ব্যাট হাতে মাঠে নামল। তুমুল অভিনন্দনে ওভাল ফেটে পড়ল। হঠাৎ ডনের মনে এল ১৮ বছর আগে এই মাঠেই শেষ টেস্ট খেলতে নামা জ্যাক হবসের কথা। ঠিক এইভাবেই তাঁকে সেদিন সংবর্ধিত করেছিল অস্ট্রেলীয়রা। ডনও ছিল তাদের মধ্যে। ওভালে তার প্রথম টেস্ট খেলা। সেই একই দৃশ্য আবার আজ।
ইয়ার্ডলি ‘থ্রি চিয়ার্স’ দেবার জন্য দলের সবাইকে ডেকে আনল উইকেটে। ডনের সৌভাগ্য কামনা করল সেএবং হাজার হাজার দর্শক, যাদের মধ্যে অনেকে ১৫ ঘণ্টা আগে থেকে লাইন দিয়ে টিকিট কেটেছে ডনের শেষ টেস্ট ম্যাচ দেখতে।
ডন, কঠিন নির্দয় ডন ব্র্যাডম্যানের হৃদয়, শীতল পেশাদারি মস্তিষ্ক সম্ভবত এই প্রথম বিচলিত হল সাধারণ মানুষের মতো। অতিমানব নয়, যন্ত্র নয়, সেযে আর পাঁচজনের মতোই আবেগবশীভূত তা এই প্রথম প্রমাণিত হল। জীবনে এই প্রথম সেহারাল একাগ্রতা, অভিনিবেশ। এই মানসিকতা গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস শুরু করার অনুপযুক্ত। নটিংহাম, লিডস, ম্যাঞ্চেস্টার এবং লর্ডস মাঠে জীবনের শেষ খেলায় ডন শতরান করেছে। ওভালে নয় কেন?
বোলার ওয়ারউইকাশায়ারের এরিক হোলিজ। কিছুদিন আগে সেতার লেগব্রেক ও গুগলি বলে অস্ট্রেলিয়ার আট জনকে আউট করেছে এক ইনিংসে। প্রথম বলটি ডন খেলল যন্ত্রবৎ, অনেকটা আন্দাজেই। দ্বিতীয় বলটি গুগলি, নিখুঁত লেংথে। ডন ফরোয়ার্ড খেলল, ব্যাটের ভিতরে কানায় লেগে বল… মহাকাব্যের উপযুক্ত পরিণতি দেওয়ার জন্য এই মহাখেলোয়াড়ের অফ-স্টাম্পের বেলটি ফেলে দিল।