যুদ্ধপূর্ব সাফল্য অতিক্রম করা আর তার পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যর্থও হতে পারে। প্রাপ্তির কিছু নেই, আছে হারানোর ভয়। যে-খেলোয়াড় জানে না কখন তাকে খেলা থেকে সরে যেতে হবে, তার থেকে করুণাকর আর কেউ হতে পারে না।
ডন জানে, এখন সেখেলা ছেড়ে দিতে পারে। খবরের কাগজ থেকে প্রচুর টাকার, কয়েক বছরে তার মোট আয়ের পরিমাণ যত, প্রায় তত টাকার প্রস্তাব এসেছে সাংবাদিক হয়ে ইংল্যাণ্ডে গিয়ে এই সফর সম্পর্কে লেখার জন্য। কেন সেখেলা ছেড়ে দেবে না? স্বপক্ষে যত যুক্তি আছে সব ক-টি নিয়েই ডন ভাবল।
কিন্তু সব যুক্তি ভেসে গেল কর্তব্যবোধের কাছে। ক্রিকেট তাকে অনেক কিছু দিয়েছে, ঋণশোধ করতেই হবে। দেশেরও এখন অধিনায়ক দরকার, এখন খেলা থেকে বিদায় নেওয়া অনুচিত।
ভারতের সঙ্গে পঞ্চম টেস্ট ম্যাচ শুরুর আগের রাতে মেলবোর্নে ডন সাংবাদিক সম্মেলনে বলল, ‘ইংল্যাণ্ড সফরে যেতে রাজি। এইসঙ্গে জানাচ্ছি, ভারতের বিরুদ্ধে খেলাটিই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে আমার শেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ, ইংল্যাণ্ড সফর শেষ হলেই ক্লাব, রাজ্য এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেব।’
পঞ্চম টেস্ট ম্যাচে ব্যাট করার সময় ডন ফাইব্রোসাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ৫৭ রানে অবসর নেয়। অস্ট্রেলিয়া ৮ উইকেটে ৫৭৫ রানে ইনিংস ঘোষণা করে (হার্ভে ১৫৩, ব্রাউন ৯৯); ভারত ৩৩১ (মাঁকড় ১১১) ও নিখুঁত পিচে ৬৭। ইনিংস ও ১৭৭ রানে জিতে অস্ট্রেলিয়া সিরিজ জিতল ৪—০ ম্যাচে। মরসুমে ডন ১২ ইনিংসে আটটি শতরান করে গড় রাখল ১২৯.৬। অষ্টম শতরানটি ইংল্যাণ্ড যাত্রার প্রাক্কালে পার্থে, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। টেস্টে ছয় বার ব্যাট করে চারটি শতরান-সহ মোট রান ৭১২; গড় ১৭৮.৭৫। একটি সিরিজে টেস্ট ইতিহাসে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গড়। প্রথমটিও ডনেরই, দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে (২০১.৫০)।
মরসুমে ডনকে বেশ হাসিখুশিই দেখাল। দর্শকরা দেখল, মাঠে সেসহখেলোয়াড়দের সঙ্গে হেসে কথা বলছে, অনেক সামাজিক হয়েছে এবং নির্দয়ভাবে খেলাটা যেন কমেছে। ডন নরম হয়ে এসেছে। এইটিই তার ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর বছর।
১৮. শেষ সফর
অধিনায়কের থেকে যদি দলে তার অধীনস্থ কয়েক জনের খেলার বয়স বেশি হয় তাহলে অধিনায়কের যে কী অসুবিধা হয় সে-অভিজ্ঞতা ডনের আছে। কিন্তু ১৯৪৮-এর ইংল্যাণ্ড সফরের জন্য দলে ৪০ বছর বয়সি ডনই সর্বজ্যেষ্ঠ। দলের কেউ তার বিচারবুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলবে এমন ভয় নেই। স্বচ্ছন্দ মুক্ত মেজাজে সেতার সৃজনশীল ক্ষমতা ও ব্যক্তিগত বিচারবোধকে প্রয়োগ করতে পারবে। ডন এমনটিই চেয়েছিল। এমন একটি দল, যাদের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রশ্নাতীত হবে, যারা তাকে পিতার মতো অনুভব করবে, উপদেশে কান দেবে, নির্দেশ মেনে চলবে এবং প্রশ্ন তুলবে না।
ডনের ধারণা, যে ক-টি দলের সঙ্গে সেইংল্যাণ্ড সফর করেছে, টেকনিক্যাল দিক থেকে ১৯৪৮ দলটিই তার মধ্যে সেরা। দলে আছে দুজন ওপেনিং ব্যাটসম্যান বার্নেস ও মরিস, তার সঙ্গে বিল ব্রাউন; তারপর ডন নিজে, হ্যাসেট, হ্যামেন্স, হার্ভে, অলরাউণ্ডার মিলার ও লক্সটন; বোলার লিণ্ডওয়াল, জনসন, ম্যাককুল, রিং ও টোশাক; উইকেট-কিপার ট্যালন ও স্যাগার্স।
অস্ট্রেলীয় দলকে নিয়ে জাহাজ ১৯ মার্চ নোঙর তুলল পারথ বন্দর থেকে, ইংল্যাণ্ডের টিলবেরি বন্দরে পৌঁছোল ১৬ এপ্রিল। এর মাঝে তাদের সই করতে হয়েছে দলের ৫ হাজার গ্রূপ ছবিতে। খেলেছে কলম্বোয়। বোম্বাইয়ে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি অ্যান্টনি ডি মেলো, বিজয় মার্চেন্ট প্রভৃতি ব্যক্তিরা জাহাজে এসে ডনকে ভারতীয় ব্লেজার ও দলের অন্যান্য সদস্যদের টাই উপহার দেন। জাহাজে তার দলের অন্যান্যদের সঙ্গে ট্যাকটিকস বিষয়ে আলোচনা ছাড়াও আর একটি ব্যাপার ডন তাদের মনের গভীরে গেঁথে দেয়—এই দল অপরাজিত থাকার ক্ষমতা রাখে।
এ পর্যন্ত কোনো অস্ট্রেলীয় দল সফরে অপরাজিত থাকেনি। ডন চেয়েছিল ১৯৪৮ সফরে অপরাজিত থাকতে। তার বিদায় মরসুমটিকে স্মরণীয় করে রাখতে।
যথারীতি লাঞ্চ, ডিনার, বক্তৃতা, সংবর্ধনা ইত্যাদির পালা শেষ হয়ে ক্রিকেট শুরু হল। শুধু শেষ হল না চিঠির জবাব এবং স্বাক্ষর দেবার পালা।
১৯৩৮ সফরে টেস্ট ম্যাচ বাদে অন্য সব ম্যাচে টস করার সময় ডন ‘টেইল’ ডেকেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সফল হয়েছে। কিন্তু ব্যর্থ হয় প্রতিটি টেস্টে। ১৯৪৮ সফরে সেস্থির করে টেস্টসমেত সব ম্যাচেই ‘হেড’ ডাকবে। উরস্টারের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচ। ডন ‘হেড’ ডাকল এবং টসে হেরে গেল। গত তিনটি সফরে উরস্টারে প্রথম খেলায় ডন দ্বিশত রান করেছে, এবারে করল ১০৭। লেস্টারসের সঙ্গে দ্বিতীয় ম্যাচে ৮১। পরের ম্যাচ ইয়র্কশায়ারের সঙ্গে, ডন খেলল না। শরীরের কথা ভেবে এবং ক্ষমতা মজুত রাখার জন্য ডন এই সফরে অনেকগুলি ম্যাচ খেলেনি বা একটি ম্যাচে দুই ইনিংসে খেলা এড়িয়ে গেছে। তখনও তার পিঠে ব্যথা রয়েছে।
ইংল্যাণ্ডের আবহাওয়ায় ও মাঠে বেডসার কেমন বল করে এটা জানতে ডন উদবিগ্ন ছিল। ওভালে সারের বিরুদ্ধে ১৪৬ করার পর ডন বোল্ড হয় বেডসারের বলে। হুবহু সেই ধরনেরই বল, যা গত বছর অ্যাডিলেড টেস্টে তাকে ০ রানে ফিরিয়ে দিয়েছিল। লেগ স্টাম্পে পড়ে ছিটকে আসে অফ স্টাম্পে। হ্যাসেটও শতরান করার পর বেডসারের ঠিক এই বলেই বোল্ড হয়। সঙ্গে সঙ্গে ডন অনুভূতিবশেই বুঝে যায়, টেস্ট ম্যাচে এই বোলারটিই অস্ট্রেলিয়ার ভয়ের কারণ হবে।