১০১ রান নিয়ে চা-এর পর ডন আরও ৭১ রান যোগ করল ৪৫ মিনিটে। অর্থাৎ প্রথম ৫০ রান ৭৮ মিনিটে, পরের ১০০ রান ৮৩ মিনিটে। তার ১৭২ রান হয় ১৭৭ মিনিটে। শততম শতরানটি এসেছে ২৯৫টি ইনিংসে।
১৯৪৭-এর ২৮ নভেম্বর ব্রিসবেনে প্রথম টেস্ট ম্যাচ শুরু হল। প্রথম দিনে ডন ১৬০ অপরাজিত। গত মরসুমের থেকে শরীর অনেক তাজা হয়ে উঠেছে। রাতে বৃষ্টি এল। পরদিন এক ঘণ্টার জন্য খেলা হয়। ডন ১৮৫ রানে হিট উইকেট হয় অমরনাথের বলে। সেব্যাট তুলে এত পিছিয়ে গেছিল ব্যাকফুট ড্রাইভ করতে যে, ব্যাট নামাবার সময় উইকেটে আঘাত করে পিছন থেকে। তৃতীয় দিনে লাঞ্চের পর খেলা শুরু হয়। অস্ট্রেলিয়া ৮ উইকেটে ৩৮২ রানে ইনিংস ঘোষণা করে দেয়। চতুর্থ দিনে খেলা হয়েছিল এক ঘণ্টার জন্য। পঞ্চম দিনে খেলা হতে পারেনি। অনাচ্ছাদিত ভিজে পিচে ভারতের ইনিংস শেষ হল ৫৮ রানে। টোসাক দুই ইনিংস বল করে ৬/২৯ ও ৫/২। দারুণ বোলিং। ভারত দ্বিতীয় ইনিংসে ৯৮ করায় অস্ট্রেলিয়া ইনিংস ও ২২৬ রানে জিতে যায়।
দ্বিতীয় টেস্ট সিডনিতে। ভারত টসে জিতে ব্যাট করতে নামার এক ঘণ্টা পরেই বৃষ্টি। খেলা আবার শুরু হলে পিচ ভারতকে সুবিধা করতে দিল না। ১৮৮ রানে ইনিংস শেষ। ফাড়কর করে ৫১। অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের শুরুতেই চাঞ্চল্য।বিনু মাঁকড় বল করতে আসার সময় বেল ফেলে দিয়ে ব্রাউনকে আবার রান আউট করেছে। প্রথম বার করেছিল কুইন্সল্যাণ্ডের সঙ্গে খেলায়, বল করার আগেই ব্রাউন ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গেছিল। মাঁকড়ের স্পোর্টসম্যানশিপ নিয়ে কথা উঠতে ডন জানাল, মাঁকড় কিছু অন্যায় করেনি। আইনে যা আছে সেতাই করেছে, নয়তো আইনটা আছে কী করতে? অন্যায় সুযোগ নিয়েছিল ব্রাউনই, তাই শাস্তি পেয়েছে। তা ছাড়া মাঁকড় তো আগেই একবার হুঁশিয়ারি দিয়েছিল।
বৃষ্টিভেজা পিচে ভারত চটপট অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস ১০৭ রানে খতম করে দেয়। ডন করে ১৩ রান। অস্ট্রেলিয়াকে তাড়াতাড়ি আউট করে ভারত ভুল করেছিল। পিচ তা ছাড়া খারাপ এবং ভারতকে সেই পিচে ব্যাট করতে নামতে হল। দিনশেষে ভারত ৭ উইকেটে ৬১। এরপর আবার বৃষ্টি এবং ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়। ৩০ ঘণ্টা খেলার ১০ঘণ্টাও খেলা হল না।
মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্ট ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়া ৩৯৪ রানে ইনিংস শেষ করে। ডনের রান ১৩২। ভারতের ইনিংস যখন ৯ উইকেটে ২৯১ (মাঁকড় ১১৬), অমরনাথ বৃষ্টি নামতে ইনিংস ঘোষণা করে দিল। ডনের মনে পড়ল ১৯৩৬-এ ‘গাবি’ অ্যালেনের ইংল্যাণ্ড দলের সঙ্গে টেস্ট ম্যাচটির কথা। সেই একই পন্থা নিয়ে সেদুই বোলার জনসন ও ডুল্যাণ্ডকে ইনিংস শুরু করতে পাঠাল কালক্ষেপের জন্য— পিচ ভালো হয়ে ওঠার জন্য সময় নিতে। জনসন আউট হতে নামল জনস্টন এবং তারপর সিড বার্নেস। চার উইকেটে ৩২ থেকে মরিস ও ডন জুড়ি রান নিয়ে গেল ২৫৫-য়। মরিস ১০০ ও ডন ১২৭ অপরাজিত। তখন আবার বৃষ্টি নেমেছে। টেস্টের দুই ইনিংসে ডন এই প্রথম দুটি শতরান করল। চতুর্থ দিনেই খেলা শেষ হল ভারতের দ্বিতীয় ইনিংস ১২৫ রানে কাদা-পিচে শেষ হওয়ায়। অস্ট্রেলিয়া জিতল ২৩৩ রানে। পিচ আচ্ছাদিত রাখার জন্য ডনের প্রস্তাবে কর্ণপাত করলে ভারতের হয়তো এতটা হেনস্থা হত না।
অ্যাডিলেডে চতুর্থ টেস্ট ম্যাচ খেলা হয় খটখটে কড়া রোদে। টসে জিতে অস্ট্রেলিয়া রান তুলল ৬৭৪। ডন করল ২০১। এটি তার জীবনের ৩৭তম দ্বিশত। এতদিন সর্বাধিক দ্বিশত রান করার রেকর্ড ছিল ইংল্যাণ্ডের ওয়ালি হ্যামণ্ডের ৩৬টি। ভারত দুই ইনিংসে ৩৮১ ও ২৭৭ করে ইনিংস ও ১৬ রানে হেরে গেলেও বিজয় হাজারে নিজেকে বিরাট ব্যাটসম্যান হিসাবে প্রতিপন্ন করে দুই ইনিংসে ১১৬ ও ১৪৫ রান দ্বারা। প্রথম ইনিংসে ফাড়কর করে ১২৩। দ্বিতীয় ইনিংসে লিণ্ডওয়াল মারাত্মক বল করে সাতটি উইকেটে পায় ৩৮ রানে। হাজারের খেলা সম্পর্কে ডন প্রথম থেকেই শ্রদ্ধাশীল ছিল। বিশেষ করে হাজারের স্ট্রোক দেওয়ার কেতাবি ধরন, খেলার জমাটি গড়ন, ডনের মনে এমনই রেখাপাত করে যে নির্দ্বিধায় সেহাজারেকে ‘গ্রেট প্লেয়ারদের’ পর্যায়ের স্থান দেয়। এই টেস্টে ১৯ বছরের একটি ছেলে প্রথম খেলতে নামে। নিল হার্ভে। রঙ্গচারির বলে ১৩ রানে এলবিডবল্যু আউট হয়।
ইংল্যাণ্ড সফরে যাওয়ার জন্য অস্ট্রেলীয় দলগঠনের সময় এসে পড়েছে। যাবে কি যাবে না, এই নিয়ে ডন চিন্তায় পড়ল। যাওয়ার ইচ্ছা খুবই, কিন্তু ব্যক্তিগত কাজকর্ম ছেড়ে প্রায় আট মাসের জন্য ক্রিকেট নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হলে তাকে অনেক কিছুই ভাবতে হয়। যেমন, বয়স প্রায় চল্লিশে পৌঁছেছে। সফরের ধকল সহ্য করার পক্ষে বয়স একটু বেশিই। মাত্র তিন জন অস্ট্রেলীয় বেশি বয়সে ইংল্যাণ্ড সফরে অধিনায়কত্ব করেছে : ১৮৯৩-এ ব্ল্যাকহ্যাম (৪০), ১৯১২-য় সিড গ্রিগরি (৪২) ও ১৯২১-এ আর্মস্ট্রং (৪২)।
১৯২৮-এর টেস্ট দলে যাদের সঙ্গে ডন খেলেছে তারা সবাই অবসৃত। ডন জানে তার ২০ বছরের অভিজ্ঞতার দাম আছে, এটা অস্ট্রেলিয়ার কাজে লাগবে। কিন্তু ইংল্যাণ্ডে আর একটি সফরে অধিনায়কত্বের বিরাট ধকলটাও যে কেমন হবে তা সেজানে। ১৯৩৮ মরসুম শেষে নিজেকেই সেবলেছিল, ‘আর কখনো নয়।’ এখন আবার তার মনে পড়ল দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা, বক্তৃতা দেওয়া, সাক্ষাৎকার ও ফোটো তোলানোর ঝামেলা, ভিড়-জনতা, চিঠির উত্তর লেখা, খেলার কৌশল নির্ধারণের জন্য চিন্তা এবং সর্বোপরি ব্যাট হাতে মাঠে নামা।