সিডনিতে অস্ট্রেলিয়া জিতল ইনিংস ও ৩৩ রানে। এটি ইংল্যাণ্ড উইকেট-কিপার গডফ্রে ইভান্সের প্রথম টেস্ট ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়ার ৬৫৯-৮ ডিক্লেয়ার করা ইনিংসে সেএকটিও বাই-রান দেয়নি। মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্টে ইয়ার্ডলি তাকে দু-বার আউট করল ৭৯ ও ৪৯ রানে। এই মাঠে ডনের একমাত্র টেস্ট খেলা, যাতে শতরান করতে পারল না। মেলবোর্নে আটটি টেস্ট ম্যাচে তার রান ১,৬৭১। গড় ১১৯.৩। ম্যাচটির মীমাংসা হয়নি এবং ৬৫ বছরে এই প্রথম টেস্ট ম্যাচ অস্ট্রেলিয়ায় অমীমাংসিত রইল। অ্যাডিলেডে চতুর্থ টেস্টেও একই ফল। এখানে বেডসার শূন্য রানে ডনকে বোল্ড করে। ডনের জীবনে ২৮৭ ইনিংসে এটি চতুর্দশতম। তবে একটি ম্যাচের দুই ইনিংসে সেকখনো ‘শূন্য’ করেনি। ডন বরাবরই বলে এসেছে বেডসার বিশ্বের সেরা বোলারদের অন্যতম এবং তার বিরুদ্ধে যত বল খেলেছে তার সেরা ছিল এই বলটি।
সিডনিতেই পঞ্চম টেস্ট খেলা হয়। অস্ট্রেলিয়া ৫ উইকেটে জিতে সিরিজ পায় ৩-০ ম্যাচে। ডন প্রথম ইনিংসে ১২ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে কঠিন সময়ে করে ৬৩ রান। অধিনায়ক ডনের আর একটি সফল মরসুম অতিক্রান্ত হল। অস্ট্রেলিয়া অপরাজিত রইল। এই প্রত্যাবর্তন মরসুমে ডনের রান ১,০৩২, গড় ৭৯.৩৮। যে দুটি লোক কদাচিৎ কোনো ব্যাপারে একমত হতে পেরেছে সেই দুজন পর্যন্ত ডনের চমকপ্রদত্বে একমত হয়ে তাকে অভিনন্দন জানাল। তারা হল অস্ট্রেলিয়ার সহ-প্রধানমন্ত্রী ড. হারবার্ট এভার্ট ও তৎকালীন বিরোধী দলনেতা রবার্ট মেঞ্জিস।
ডন কিন্তু জানে, যুদ্ধের আগে তার যা খেলা ছিল এখন তা আর নেই। এখন তার খেলা ভালো একজন টেস্ট ক্রিকেটারের মতো মাত্র। অথচ যুদ্ধের আগে সেখেলেছে জুড়িহীন প্রতিভাধরের মতো। তার একটা মুশকিল, টেস্ট ম্যাচগুলির মধ্যে সেআর অন্য ম্যাচ খেলেনি। প্র্যাকটিস খুবই দরকার কিন্তু স্বাস্থ্যের কথা ভেবে ডন ভরসা পায়নি আর খেলতে। কিন্তু এখন সেঠিক করল আরও কিছুদিন খেলবে। ভারতীয় দল অস্ট্রেলিয়া সফরে আসছে। অধিনায়ক লালা অমরনাথ, ম্যানেজার পঙ্কজ গুপ্ত বলেছে, তাদের আশা ডন নিশ্চয়ই তাদের বিরুদ্ধে খেলবে, কেননা তার কাছে অনেক কিছু তারা শিখতে চায়।
ডন জানাল সেখেলার জন্য তৈরি থাকবে অর্থাৎ ভারতীয়দের জন্য প্রচুর শিক্ষা মজুত থাকবে!
১৭. শততম শতরান
এখন ডনের প্রত্যাবর্তন সম্পূর্ণ। মাঠের চারিদিকে দর্শকদের অভিনন্দন আবর্তিত হচ্ছে। ভারত থেকে অস্ট্রেলিয়ায় এই প্রথম ক্রিকেট দল আসছে, তাই কৌতূহল অন্যদের মতো ডনেরও প্রবল। দুই দেশের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের মধ্যে খেলার ব্যাপারে স্থিরীকৃত শর্তে একটি বিষয়ে দ্বিমত হয়। ভারত চায় উইকেট অনাচ্ছাদিত থাকবে। অর্থাৎ বৃষ্টি হলে ভিজে উইকেটের সুযোগ নেবে। ডনের মতে, ভারত ভুল করেছে। ভিজে উইকেটে খেলার অভিজ্ঞতা বা দক্ষতা ভারতীয়দের থেকে অস্ট্রেলীয়দের একটু বেশিই। তা ছাড়া তাড়াতাড়ি খেলা শেষ হলে বা একপেশে জয় ঘটলে দর্শক কমে যাবে, ফলে আর্থিক লোকসান ঘটবে। ডনের এইসব যুক্তি মেনে নিয়েও অমরনাথ কিন্তু উইকেট আচ্ছাদনে রাজি হল না। তবে অমরনাথের সোজাসুজি কথাবার্তা, পরিচ্ছন্ন অমায়িক সহযোগিতামূলক আচরণ ডনকে খুশি করে। সেঅবাক হয়ে ভাবে, এমন লোককে ১৯৩৬-এর ইংল্যাণ্ড সফর থেকে কেন ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছিল।
১৯৪৭-৪৮ মরসুমে ডন প্রথম ম্যাচ খেলল অ্যাডিলেডে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে। প্রথম ইনিংসে ১৫৬ রান করে মাঁকড়ের বলে সরবটের হাতে ক্যাচ আউট হয়। দ্বিতীয় ইনিংসে মাঁকড়ের বলে প্রবীর সেন তাকে স্টাম্প করে ১২ রানে। ডন জীবনে ১২ বার স্টাম্পড হয়েছে, এটি একাদশতম। ডনের এই শতরান প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার ৯৮তম। এই খেলা থেকেই তার ধারণা হয়, ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে টেস্টে অস্ট্রেলিয়া প্রচুর রান করবে প্রধানত দুটি কারণে : ওদের প্রকৃত ফাস্ট বোলার এবং উচ্চ শ্রেণির প্রকৃত স্পিনার নেই আর ফিল্ডিংয়ে অত্যন্ত দুর্বল।
ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে ডনের ১০০, তার জীবনের ৯৯তম শতরান। এবার সিডনিতে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলীয় একাদশের অধিনায়করূপে ডন খেলবে। আর একটি শতরান করলেই শততম শতরানটি হবে। তখনও পর্যন্ত ১০ জন ইংরেজ ছাড়া আর কেউ এই কৃতিত্ব অর্জন করেনি। স্বভাবতই ডন ব্যগ্র এই সম্মানের একাদশতম অধিকারী হওয়ার জন্য। সিডনি মাঠেই সেশতরানটি চায়, কেননা এই মাঠকেই সেসবথেকে ভালোবাসে। এই মাঠের দর্শকদের কাছ থেকে সেবরাবরই সহানুভূতি ও স্নেহ পেয়েছে।
সিডনিতে ভারত ৩২৬ করার পর অস্ট্রেলিয়া ব্যাট শুরু করে ব্রাউন ও রজার্সকে হারাল ৩১ রানে। ডন ও কিথ মিলার ব্যাট করছে। দর্শকের ভিড় বাড়ছে। তারা দেখতে এসেছে, ডন হয়তো শততম শতরানটি করবে।
ডন ৯০-এ। আর দশটি রান দরকার। ডন একটু যেন নার্ভাস বোধ করল। একবার দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে প্রায় রান আউট হয়ে যাচ্ছিল।
অবশেষে ৯৯-এ। চা-পানের বিরতি এক ওভার পরেই।
অমরনাথ হঠাৎ বাউণ্ডারি থেকে কিষেণচাঁদকে ডাকল বল করার জন্য। ডন বিভ্রান্ত বোধ করল। এই লোকটি তো কখনো বল করেনি, কী ধরনের বোলার! অমরনাথ কূটচাল চেলেছে। পোক্ত ব্যাটসম্যানরাও ঠকে যেতে পারে। ডন অত্যন্ত সমীহভরে কিষেণচাঁদের প্রথম বলটি দেখে খেলল। মিড অনে দ্বিতীয় বলটি পাঠিয়েই একটি রান নিল। দর্শকরা স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দনের বন্যায় মাঠ প্লাবিত করল। ডনের ১০০, মিলারের ৬৩। অস্ট্রেলিয়া ৪৭ ওভারে ১৮৮/২।