ডন নিজেও জানে না এর উত্তর। তবে এটুকু সেজানে, মোটামুটি স্বাস্থ্য আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার জন্য পেশির যে তেজিয়ান অবস্থা দরকার এই দুইয়ের মধ্যে বিস্তর প্রভেদ আছে। ব্যর্থ হবার জন্য ডন খেলতে রাজি নয়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার যে তাকে এবং তার অভিজ্ঞতাকে দরকার এটা সেবুঝতে পারে। এইসময় তার স্ত্রীর একটি অনুরোধ তাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। ‘জন কি এক বারও তার বাবাকে টেস্ট ক্রিকেট খেলতে দেখবে না?’
নিশ্চয় দেখবে। ডনের মনে হচ্ছে আর একটা মরসুম হয়তো সেখেলতে পারবে। ছেলের সামনে টেস্ট ম্যাচ খেলতে হলে এই মরসুমেই খেলতে হবে। ডন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতামত চাইল। তারা পরিষ্কার জানালেন, টেস্ট ম্যাচ খেলার চিন্তা ত্যাগ করো।
ডন নাছোড়বান্দার মতো জিজ্ঞাসা করল, ‘যদি চেষ্টা করি, তাহলে কি চিরকালের জন্য আমার স্বাস্থ্য জখম হবে?’
তাঁরা অনিচ্ছুকভাবেই বললেন, না হবে না, যদি-না বাড়াবাড়ি রকমের ধকল পোহাতে হয়। তবে যুদ্ধের আগে যে-খেলা ছিল তা আর ফিরে পাবে না। চেষ্টা করলেও পাবে না।
ডন দ্বিধায় পড়ল। অনেক ভেবে অবশেষে ঠিক করল, আগে তাহলে কয়েকটা ম্যাচ খেলে দেখি। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে হ্যামণ্ডের এমসিসি দলের বিরুদ্ধে করল ৭৬ ও ৩। ডন আর আগের ডন নেই, ছায়ামাত্র—শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকেই। খবরের কাগজে লেখা হল, বিরাট এক ক্রিকেটারের প্রেতচ্ছায়া দেখা গেল এবং প্রেতরা কদাচিৎ জীবন ফিরে পায়। যেসব ছেলেরা যুদ্ধের আগে ডনের খেলা দেখেনি, তারা ঠোঁট মোচড়াল।
দমে গেল ডন। এইভাবেই কি তাচ্ছিল্যের মধ্য দিয়ে বিদায় নিতে হবে ক্রিকেট থেকে? ডন ঝুঁকি নিয়ে মেলবোর্নে এলএমসিসি-র বিরুদ্ধে অস্ট্রেলীয় একাদশের অধিনায়কত্ব করতে। দর্শকরা উৎফুল্ল হয়ে দেখল, প্রেতচ্ছায়া জীবনের কায়া পেয়েছে। ডন যখন ষাটের ঘরে তখন পায়ের একটা পেশি ছিঁড়ে যায়। সেই অবস্থায় সেকরল ১০৬। পরের ম্যাচ ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে, আর একটি শতরান—১১৯।
অস্ট্রেলিয়া জুড়ে এখন শুধু ডনের কথা। আবার ডন নিজেকে ফিরে পেয়েছে। ডন নিজেও ভাবল নিজের সম্পর্কে। ওরিলি অবসর নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। অত বড়ো বোলার অবসর নেওয়া মানে অস্ট্রেলিয়ার শক্তির একটি স্তম্ভ সরে যাওয়া। অভিজ্ঞ পুরোনোদের মধ্যে হ্যাসেট, ব্রাউন এবং বার্নেস ছাড়া আর কেউ নেই। তাও বার্নেস খেলেছে মাত্র একটি টেস্ট। ইংল্যাণ্ডের আছে যুদ্ধপূর্ব টেস্ট খেলোয়াড় ছয় জন। অস্ট্রেলিয়ার এখনই সবথেকে বেশি দরকার ডনকে। কিন্তু ছয় দিনের টেস্ট খেলার ক্ষমতা কি তার আছে? ডন জানাল, ব্রিসবেনে প্রথম টেস্ট ম্যাচটিতে খেলব।
ডন টসে জিতল। মরিস ও বার্নেস আউট হবার পরই ডনের রান যখন ২৮, তখন একটি ঘটনা ঘটে যা আজও ক্রিকেট দুনিয়ায় তর্কাতর্কির বিষয় হয়ে আছে। ভোসের একটি প্রায় ইয়র্কার বলকে ডন স্লিপ ফিল্ডারদের বাইরে দিয়ে পাঠাবার জন্য চপ করে। আগের আমলের ডন এই স্ট্রোক নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করত। কিন্তু এক্ষেত্রে বলটি দ্বিতীয় স্লিপ জন আইকিনের হাতে উড়ে এল।
ডন ক্রিজে দাঁড়িয়ে, ফিল্ডাররাও নীরব। তারপরই ক্যাচ আউটের আবেদন উঠল। আম্পায়ার বরউইক বললেন, ‘নট আউট।’ ডন ক্রিজে দাঁড়িয়েছিল যেহেতু তার মতে সেক্যাচ আউট নয়। বল তার ব্যাট থেকে মাটিতে পড়ার পর আইকিনের হাতে গেছে।
ইংল্যাণ্ড খেলোয়াড়রা প্রথমে নীরব ছিল কেন? তাদের বক্তব্য : স্পষ্ট ক্যাচ আউট তাই তারা ভেবেছিল ডন নিজে থেকেই ক্রিজ ত্যাগ করবে। তাই প্রথমে আবেদন করেনি। বোলার ভোস, আইকিন, প্রথম স্লিপে হ্যামশু এবং গালিতে দাঁড়ানো ইয়ার্ডলির ধারণা ডন ক্যাচ দিয়েছে।
ডন সেদিন অপরাজিত থাকে ১৬২ রান করে। পরদিন ১৮৭ রানে আউট হয়। এই নিয়ে ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে পর পর সাতটি টেস্ট ম্যাচে তার শতরান হল।
আম্পায়ারের সেই সিদ্ধান্তের ধাক্কা সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। ডনের ১৮৭ রান এবং বৃষ্টি অস্ট্রেলিয়াকে ইনিংস ও ৩৩২ রানে জেতায় প্রথম টেস্টে, যার ফলে অস্ট্রেলিয়া আত্মবিশ্বাস পেয়ে সিরিজ জেতে। তা-ই নয়, ডনের খেলোয়াড় জীবনের মোড়ও ফিরিয়ে দেয় এই সিদ্ধান্ত। যদি ২৮ রানেই তাকে ফিরে যেতে হত, তাহলে সেধরে নিত আর প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়। টেস্ট ক্রিকেট থেকেই সেবিদায় নিত। কিন্তু ১৮৭ করার পর সেস্থির করে খেলে যাবে।
সিডনিতে দ্বিতীয় টেস্টে ডন ৩৯১ মিনিটে করল ২৩৪ রান। বার্নেসও করল ২৩৪ রান। পঞ্চম উইকেটে দুজনে বিশ্বরেকর্ড করল ৪০৫ রান তুলে। ডন উপর্যুপরি আটটি টেস্টে আটটি শতরান করল। ডন তার পুরো ইনিংসটাই ব্যাকফুটে খেলে যায়। খেলার প্রথম দিনে ফিল্ড করার সময় ঊরুর পেশি ছিঁড়ে যাওয়ায় তার পা-টি বেশ ভালোভাবেই ব্যাণ্ডেজ করা ছিল। পা বাড়িয়ে খেলার উপায় ছিল না।
ডন ও বার্নেসের মধ্যে আগে আউট হয় ডন। বার্নেস ভালোই খেলে যাচ্ছিল। তার রান ২৩৪-এ পৌঁছোতেই ইচ্ছে করে ক্যাচ তুলে দিয়ে ফিরে আসে। ব্যাপারটা কী? জবাবে বার্নেস বলে, ডনের সঙ্গে নিজের নামটা এক বারের জন্য পাকাপাকি জুড়ে দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না। ঠিক একই ব্যাপার করেছেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক মার্ক টেলর ১৯৯৮ পেশোয়ারে দ্বিতীয় টেস্টে ৩৩৪ রানে পৌঁছে ইনিংস ছেড়ে দেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, ব্র্যাডম্যানের ৩৩৪-এর সঙ্গে নিজেকে জুড়ে রাখার বাসনায়। অমর হতে কে না চায়?