সেনাবাহিনীতে কঠোর ক্যাম্পজীবনে ডনের পিঠের ব্যথাটা আবার চাগিয়ে ওঠে। চোখেও গোলমাল শুরু হয়। কিন্তু এ সম্পর্কে কাউকে সেকিছু বলেনি। এক চক্ষু বিশেষজ্ঞ তখন পাইলটদের জন্য দৃষ্টিশক্তি সম্পর্কে বিশেষ গবেষণা করছিলেন। ডনের দৃষ্টিশক্তি তখন বিশ্বখ্যাত। বিশেষজ্ঞটি যেই খবর পেলেন ডন ক্যাম্পে রয়েছে, অমনি লাফিয়ে উঠলেন। এ সুযোগ ছাড়া যায় না। হয়তো ডনের চোখ পরীক্ষা দ্বারা আবিষ্কার করে ফেলতে পারেন তার অকল্পনীয় ব্যাটিং সাফল্যের চাবিকাঠিটি।
ডন তখন রীতিমতো চোখে খারাপ দেখছে। নানা ছুতোয় সেবিশেষজ্ঞটিকে এড়িয়ে যেতে লাগল। নিরুপায় হয়ে বিশেষজ্ঞ তখন ডনের ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের শরণাপন্ন হয়ে ডনের ওপর আদেশ জারি করাল চোখ পরীক্ষার জন্য আত্মসমর্পণ করতে। পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞ স্তম্ভিত। ডনের চোখে অসুস্থতার লক্ষণ।
তা সত্ত্বেও ডন দুটি ম্যাচ খেলে। রান করে ০ ও ৬ এবং ০ ও ১২। ভালো করে বল দেখতে পাচ্ছিল না। অবশেষে ধরা পড়ল রোগটা—ফাইব্রোসাইটিস। রোগের কারণটা ধরা শক্ত তবে অনুমান করা হয়, অত্যধিক ধকল এবং ক্রমান্বয়ে উদবেগই এর অন্যতম কারণ। ডনের মনে হয়েছে, প্রথমদিকের টেস্ট ম্যাচগুলির ধকল এবং অধিনায়কত্বের উদবেগ থেকেই হয়তো রোগটার শুরু।
বার তিনেক হাসপাতালে কাটিয়ে মেডিক্যাল বোর্ডের সামনে তাকে আসতে হল। তারা রায় দিল, সম্পূর্ণ বিশ্রাম। দীর্ঘ বিশ্রাম। একদম কোনো কাজ বা খেলা নয়।
এর পরের পাঁচটি বছর অন্ধকারে ঢেকে দেয় ডনের খেলোয়াড় জীবনকে।
চটপটে তৎপর যে-মানুষটিকে হাজার ক্রিকেটপাগলরা জেনেছিল সক্ষমতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে, সেএখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। যৌবনের মধ্যাহ্নেই বার্ধক্যের আঁধার নেমে এল। ডান হাতটা একদমই ওঠাতে পারে না। নিজের চুল আঁচড়াতে পারে না। স্ত্রী দাড়ি কামিয়ে দেয়। ডান হাতের বুড়ো আঙুল ও তর্জনীতে কোনো সাড়া নেই। কোনোদিনই আর সাড় আসেনি। পরবর্তী টেস্ট ম্যাচগুলি সেনি:সাড় দুটি আঙুল নিয়েই খেলেছে।
ডন কয়েক মাস বাওরালে গ্রামীণ পরিবেশে কাটিয়ে আবার অ্যাডিলেডে ফিরে এল। আবার যে ক্রিকেট খেলতে পারবে, এটা তখন তার চিন্তার বাইরে। এই সময়েই ডন এক বন্ধুকে লিখেছিল, ‘এয়ার রেইড ওয়ার্ডেন হওয়ার যোগ্যতাও আমার নেই।’ দু-বছর সেব্যাট বা বল বা গলফ ক্লাব ছোঁয়নি। শুধুমাত্রই তার শেয়ার দালালি অফিসে কাজ করে গেছে।
ইংল্যাণ্ডে এক বন্ধুকে সেতখন লেখে :
নিশ্চিতভাবেই আমি ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছি, এমনকী ক্লাব ক্রিকেটকেও। এখন বাতগ্রস্ত বুড়োলোকের মতো চলাফেরা করি। যা-কিছু এখন আশা তা হচ্ছে আগামী দিনগুলো সম্পর্কে, যখন আমার ছেলে, এখন যার চার বছর বয়স, ওরই বয়সি স্ট্যান ম্যাককেবের ছেলে, বিল ব্রাউনের ছেলে, তারও বয়স চার, ওরা যখন একদিন তাদের বাবাদের মনে সবুজ করে তুলবে লর্ডসের, ওল্ড ট্রাফোর্ডের, হেডিংলির, টেন্ট ব্রিজের আর ওভালের স্মৃতি।
এই সময়ই জন্মাল ডনের মেয়ে শার্লি। মেয়েটি জন্ম থেকেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত।
ইউরোপে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। ১৯৪৫-এর সেই আনন্দের বছরে ডন একটি বিপদের মুখে পড়ল। যে-ব্যবসায় অফিসে সেকাজ করত সেটি দেউলে হয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলল। নিজে পঙ্গু, একটি পঙ্গু সন্তান, তার ওপর কর্মহীন।
এবার ডন নিজের শেয়ার দালালি ব্যাবসা শুরু করল। শরীরে কুলোয় না তবু খাটতে লাগল অমানুষিকভাবে। এবং এই সময়েই সেবুঝতে পারল তার খেলা কত লোকের মন জয় করে রেখেছে। ধীরে ধীরে তার ব্যাবসা বেড়ে উঠল, ধীরে ধীরে স্বাস্থ্য ফিরে এল, সেইসঙ্গে দৃষ্টিশক্তিও।
অস্ট্রেলিয়ান সারভিসেস ক্রিকেট দল হ্যাসটের অধিনায়কত্বে ইংল্যাণ্ড ও ভারতে খেলে দেশে ফিরেছে। ১৯৪৫-এর ডিসেম্বরে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে সারভিসেস দলের বিরুদ্ধে খেলার জন্য ডন অনুরুদ্ধ হল। পাঁচটি বছর সেকোনো পর্যায়েরই ক্রিকেট খেলেনি, তাই মনে মনে ইতস্তত করলেও, এখনও তার আগের ক্ষমতা বজায় আছে কি না সেটা যাচাইয়ের এই সুযোগ সেহাতছাড়া করতে পারল না। তবে তার আগে কুইন্সল্যাণ্ডের সঙ্গে একটা ম্যাচ খেলেছিল। করল ৬৮ ও অপরাজিত ৫২। রানগুলো করতে তাকে অসম্ভব কষ্ট করতে হয়। সারভিসেস দলের বিরুদ্ধে ডন করল ১১২ রান। টগবগানির বদলে ধীরস্থির ইনিংস।
এক মাস পরই ফাইব্রোসাইটিস আবার মারাত্মকভাবে আক্রমণ করল ডনকে। লেখার ক্ষমতা পর্যন্ত লোপ পেল। অস্ট্রেলিয়া থেকে ক্রিকেট দল নিউজিল্যাণ্ড যাচ্ছে। ডন জানাল যাওয়া সম্ভব নয়।
নির্বাচক কমিটির এক সদস্য ডনকে বলল, মেলবোর্নে আর্ন সণ্ডার্স নামে এক খুব নামি মালিশওয়ালা আছে, তার কাছে গিয়ে মালিশ করাতে। কিছুটা দৈবের ওপর ভরসা করেই ডন এল সণ্ডার্সের কাছে। প্রথম দিন সণ্ডার্সের আঙুল যখন ডনের পিঠে বেদনার উৎসমূলটি খোঁজাখুঁজি করছিল, যন্ত্রণায় তখন সেঅর্ধমৃত হয়ে পড়ে। সণ্ডার্স সফল হয়েছিল। ডন আর যন্ত্রণাবোধ করেনি। স্বীকার করেছে সণ্ডার্সের চিকিৎসাতেই সেআবার ক্রিকেটে ফিরে আসতে পেরেছে।
১৬. প্রত্যাবর্তন
এমসিসি অস্ট্রেলিয়া সফরে আসছে ১৯৪৬-এর শেষে হ্যামণ্ডের নেতৃত্বে। ডন কি ওদের বিরুদ্ধে খেলার যোগ্য স্বাস্থ্য ইতিমধ্যে ফিরে পাবে? সারা অস্ট্রেলিয়ায় তখন এই প্রশ্ন।