হাটন যখন ৩৩৪ রানের দিকে এগোচ্ছে তখন ডন সিলি মিড-অফে এসে দাঁড়ায়। অনবদ্য কাট করে হাটন ৩৩১ থেকে ৩৩৫-এ পৌঁছোতেই ডন সর্বপ্রথম হাত বাড়িয়ে দেয় অভিনন্দন জানাতে। ৩০ হাজার দর্শক গেয়ে ওঠে ‘ফর হি ইজ এ জলি গুড ফেলো’। এই টেস্টে ইংল্যাণ্ড দলে ইয়র্কশায়ারের পাঁচ জন মিলে ৬১২ রান করে ও ১০টি উইকেট পায়। তাদের উইকেটকিপার উড তিনটি ক্যাচ ধরে ও ৫৩ রান করে।
খেলার তৃতীয় দিন লাঞ্চের পর ক্লান্ত বোলারদের রেহাই দেবার জন্য ডন নিজে বল করতে এল। ১৯৩০-এর পর ইংল্যাণ্ডের মাঠে এই তার প্রথম বল-করা। দ্বিতীয় বলটি করার সময় বোলারদের পায়ে তৈরি গর্তে তার পা ঘুরে গিয়ে পায়ের গোছের একটা হাড় সামান্য ভাঙল। তাকে তুলে নিয়ে যেতে হল মাঠ থেকে। তৃতীয় দিন চা পানের পর হ্যামণ্ড যখন শুনল ডন ব্যাট করতে পারবে না তখনই নিশ্চিন্ত হয়ে ইনিংস ঘোষণা করে। হ্যামণ্ড জানত, এই সহজ ব্যাটিং উইকেটে ডনের প্রতিভাকে দমিয়ে রাখার সাধ্য তার বোলারদের নেই। নশো রানের মোকাবিলা করতে ডন যে কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠবে কেউ তা জানে না।
এই টেস্টে ডন ব্যাট ধরেনি। পায়ের পেশি জখম করে ফিঙ্গলটনও মাঠ থেকে ফিরে এসেছে। মনমরা অস্ট্রেলিয়ার দল ভেঙে পড়ল ২০১ এবং ১২৩ রানে। সিরিজের ফল ১ : ১। ডন সফরের বাকিটুকুতে আর খেলতে পারেনি। তার হাঁটা বারণ, এমনকী বিলিয়ার্ডস খেলা পর্যন্ত। মিডলসেক্সের ও ইংল্যাণ্ডের বিখ্যাত বোলার ওয়াল্টার রবিন্সের বারনহামের বাড়িতে সেবিশ্রাম নেয় তাস খেলে, পিয়ানো বাজিয়ে আর চিঠির উত্তর দিয়ে। দেশের বাইরে ডনের এই প্রথম সফর অধিনায়কের দায়িত্ব নিয়ে। দায়িত্বের চাপটা যে কী প্রচন্ড তা সেভালোভাবেই বুঝেছে। প্রায়শই তার মনে হত, ভবিষ্যতে এইরকম আর একটা সফরে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব নিতে আর সেপারবে না। দেশে ফিরে বড়োজোর আর একটা টেস্ট সিরিজ, তারপরই অবসর।
কিন্তু দশ বছর পর অস্ট্রেলিয়াকে সবথেকে মর্যাদাপূর্ণ, অজেয় সফরের নেতৃত্ব দেবার জন্য ডন আবার ইংল্যাণ্ডে ফিরে এসেছিল।
ডন ১৯৩৮ ইংল্যাণ্ড সফরে ২৬ ইনিংস খেলে সংগ্রহ করে ২,৪২৯ রান। আজ পর্যন্ত কোনো বিদেশি দলের কেউ ইংল্যাণ্ডের মাঠ থেকে এত রান বা ১৩টি শতরান (তাতে তিনটি দ্বিশত) তুলতে পারেনি। ডনের গড় হয় ১১৫.৬৬ রান। ইংল্যাণ্ডে একটি মরসুমে ১৫টির বেশি ইনিংস খেলেছে এমন কোনো ব্যাটসম্যান এখনও পর্যন্ত এই গড় স্পর্শ করতে পারেনি। এই মরসুমে ইংল্যাণ্ডে সবথেকে বেশি মোট রান করে হ্যামণ্ড, ৪২ ইনিংসে ৩,০১১ রান; ৭৫.২৭ গড়। ১৯৩৮-এ ডন ইংল্যাণ্ডে ১৩টি শতরান করে ১৯টি ম্যাচে। দশ বছর পর ফিরে এসে ১৯৩৮-এর মোট রান থেকে সেমাত্র একটি রান ও দুটি শতরান কম করে।
১৫. অন্ধকার পাঁচটি বছর
১৯৩৮-এ ইংল্যাণ্ড থেকে ডন সস্ত্রীক দেশে ফেরার পথে ট্রেনে ফ্রান্সের মধ্য দিয়ে গিয়ে জাহাজে উঠেছিল। ট্রেনে সেশুনেছিল, আর যুদ্ধের ভয় নেই। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেন তার ছাতাটিকে সঙ্গে নিয়ে মিউনিখ গিয়ে হিটলারের সঙ্গে বোঝাপড়ায় এসেছেন।
এক বছর পরই যুদ্ধ শুরু হয়।
কিন্তু তার আগে, ইংল্যাণ্ড থেকে ফিরে ১৯৩৮-৩৯ মরসুমে ডন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়াকে শেফিল্ড শিল্ড বিজয়ী করে। এই সময়ই তার পুত্র জন রাসেল ভূমিষ্ঠ হয়। এটা ডনের জীবনের অসাধারণ মরসুম। মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবের শতবার্ষিকী ম্যাচে ১১৮ দিয়ে শুরু করে পর পর ইনিংসে সেকরে ১৪৩, ২২৫, ১০৭, ১৮৬, ১৩৫। পর পর ছয় ইনিংসে ছয়টি শতরান। ১৯০১-এ স্থাপিত ইংল্যাণ্ডের সিবি ফ্রাইয়ের বিশ্বরেকর্ডের সমান। পর পর ছয় ইনিংসে শতরান আর করেছে ১৯৭০-৭১ মরসুমে রোডেসিয়ার মাইক প্রোক্টর। ডন অবশ্য চেষ্টা করেছিল সপ্তম শতরানটি করতে, কিন্তু যে-লোকটি খুবই বাজে ফিল্ডার হিসাবে খ্যাত সেই ফ্লিটউড স্মিথ আচমকা ডনের একটি প্রচন্ড ড্রাইভ পায়ের গোড়া থেকে ধরে ফেলায় ফ্রাইয়ের রেকর্ড ভাঙা হল না। ডনের রান তখন ৫।
নিজেকে সক্ষম রাখার জন্য ডন স্কোয়াশ খেলতে শুরু করে। এবং তার যা স্বভাব, যে-খেলায় মন দেবে সেটিতে চূড়ায় পৌঁছোতেই হবে। ডন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া রাজ্য স্কোয়াশ চ্যাম্পিয়ন হল ডেভিস কাপ খেলোয়াড় ডন টার্নবুলকে এক ঘণ্টা প্রচন্ড লড়াইয়ের পর ৩-২ সেটে হারিয়ে। সারাদিন ব্যাটিংয়ের থেকেও এই এক ঘণ্টার ধকল তার কাছে বেশি মনে হয়েছে। অথচ হ্যারি হপম্যান তাকে উপদেশ দিয়েছিল, আধ ঘণ্টার বেশি কখনো স্কোয়াশ না খেলতে। এরপর ডন আর কখনো প্রতিযোগিতামূলক স্কোয়াশ খেলায় নামেনি।
১৯৩৯ সেপ্টেম্বরে যুদ্ধ শুরু হলেও ১৯৩৯-৪০ মরসুমে অস্ট্রেলিয়ায় ক্রিকেট খেলা বন্ধ থাকেনি। জাতীয় জীবনে আস্থা ও সাহস বজায় রাখার জন্যই অস্ট্রেলীয় সরকার ক্রিকেট বন্ধ হতে দেয়নি। ডন নাম লেখাল রয়াল অস্ট্রেলিয়ান এয়ার ফোর্সে। বয়স তখন ৩২। এয়ার ফোর্সের পক্ষে বয়সটা একটু বেশিই। তা ছাড়া তখন যত-না বিমান এবং বিমান বাহিনীতে প্রশিক্ষণের সুযোগ তার থেকেও বেশি হয়ে গেছিল মানুষের সংখ্যা। তাই ডনকে বদলি করা হয় সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্টরূপে শারীর প্রশিক্ষকের কাজে।
১৯৩৯-৪০ মরসুমে ডন ৯টি ম্যাচ খেলেছে। তার মধ্যে নিউ সাউথ ওয়েলসের বিরুদ্ধে দুই ইনিংসেই অপরাজিত ২৫১ ও ৯০। তার মতে, শেফিল্ড শিল্ডে জীবনের সেরা খেলা, কারণ বিপক্ষে বল করেছে ওরিলি। এই মরসুমে ওরিলি ছিল মারাত্মক, ৫২ উইকেট নেয় ১৩.৫ গড় রানে। ডন একাই লড়েছিল তার সঙ্গে। প্রথম ইনিংসে গ্রিমেটকে নিয়ে শেষ উইকেটে ১১৩ রানের মধ্যে ডন করে ৮৭। দ্বিতীয় ইনিংসে দলের ১৫৬/৩ এবং তাতে ডনের ৯০ রান।