হৃদয় আলোড়নকারী ক্রিকেট। তার ব্যাটের নিখুঁত স্পর্শ নান্দনিক বোধকে নাড়া দেয়। ম্যাককেব ইংলিশ আক্রমণকে ধ্বংস করে আভিজাত্যিক বিনয় সহকারে, সুরুচি দ্বারা।
ডগলাস রাইটের তিন ওভারে ম্যাককেব নেয় ৪৪ রান এবং শেষদিকে ৭২ রান করে ২৮ মিনিটে, শেষ উইকেটে যোগ করে ৭৭ রান। তবু ফলো অন এড়ানো গেল না। জয়ের জন্য নয়, ম্যাচ বঁাচানোর জন্য এবার ডনকে খেলতে হবে। উইকেটে ক্ষয় ধরেছে, বোলারদেরই প্রাধান্য এখন। ম্যাচের শেষ পর্যন্ত ডন ব্যাট করল অসাধারণ সংযমে, প্রকৃতি-বিরুদ্ধ রক্ষণাত্মক মেজাজে নিখুঁত টেকনিকে, শুধু দলের মর্যাদা রক্ষার জন্য। তাকে যোগ্য সাহচর্য দেয় বিল ব্রাউন ১৩৩ রান করে। এমন ডনকে লোকে আগে কখনো দেখেনি। সারাদিন ব্যাট করে ১৪৪ রানে অপরাজিত। পিঠের ব্যথাটাও আবার চাগিয়ে উঠেছে। পিচ থেকে ধুলোর কণা চোখে গিয়ে চোখ করকর করছে। কিন্তু ম্যাচ তাকে বঁাচাতেই হবে। অত্যন্ত বিরক্তিকর ইনিংস সেখেলল, যে-খেলা দর্শকরা দ্রুত মন থেকে তাড়িয়ে দিতে পারলে হাঁফ ছাড়বে। কিন্তু ডনের কাছে এই ইনিংস তার সেরাগুলির অন্যতম, বীরত্ব ব্যঞ্জনায় শ্রেষ্ঠত্বের থেকে কোনোমতেই ন্যূন নয়। অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসে ৬ উইকেটে ৪২৭ রান করার পর খেলা শেষ হয়।
লর্ডসে দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচও অমীমাংসিত রয়ে যায়। দ্বিতীয় ইনিংসে ডন ১০২ রানে অপরাজিত থাকে ১৪০ মিনিট ব্যাট করে। এই শতরান পর পর পাঁচটি টেস্ট ম্যাচে তার পঞ্চম শতরান। তা ছাড়া তখন ইঙ্গ-অস্ট্রেলীয় দুই দেশের মধ্যে টেস্ট খেলায় জ্যাক হবসের ৩,৬৩৬ মোট রানের রেকর্ডটিও ডন অতিক্রম করে। এই টেস্টে হ্যামণ্ড ২৪০ করে এবং অস্ট্রেলিয়ার ৪২২ রানের প্রথম ইনিংসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যাট করে বিল ব্রাউন ২০৬ রানে অপরাজিত থেকে যায়। দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যাণ্ডের অর্ধেক ব্যাটসম্যান ৭৬ রানে ফিরে আসার পর তরুণ কম্পটন অসাধারণভাবে ৭৬ রান না করলে হয়তো অস্ট্রেলিয়া জেতার সুযোগ পেত। ইংল্যাণ্ড করে ৮ উইকেটে ২৪২। প্রসঙ্গত বলে রাখি, লর্ডস প্যাভিলিয়নে বসেই ডন প্রথম টেলিভিশন সেট চোখে দেখে। দেখেছিল উইম্বলডন টেনিস। টিভি-র তখন শৈশবকাল।
তৃতীয় টেস্ট ম্যাচটি শুরুই হল না। মাঠে একটা বলও পড়ল না। দুই অধিনায়ক টস করারও দরকার বোধ করল না। কারণ বৃষ্টি, অবিশ্রান্ত অঝোরে দিনের পর দিন বৃষ্টি। তৃতীয় টেস্টম্যাচের স্থান? অবশ্যই ম্যাঞ্চেস্টার ছাড়া আর কোথায়ই-বা হবে!
লিডসে চতুর্থ টেস্ট ম্যাচ। ডনের মতে, আধুনিক কালে অন্যতম সেরা টেস্ট ম্যাচ। ভালো পিচে ইংল্যাণ্ডের প্রথম ইনিংস শেষ হল ২২৩ রানে। আকাশে ঘন মেঘ জমে উঠছে। বৃষ্টি আসবে। আসবেই। এইবার অধিনায়ক ডনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। আলো কম বটে কিন্তু উইকেটের অবস্থা ভালো, বৃষ্টির পর আলো ভালো হবে বটে কিন্তু উইকেট খারাপ হবে—তাহলে কোন অবস্থায় ব্যাটিং শ্রেয়? ডন ঠিক করল প্রথম অবস্থাটিরই সুযোগ নেওয়া ভালো। ব্যাটসম্যানদের প্রতি তার নির্দেশ : ‘আর যাই করো, আলো কম হওয়ার জন্য আবেদন কোরো না।’
রীতিমতো অন্ধকারেই অস্ট্রেলিয়া ব্যাট করেছিল। মাঠের মাঝ থেকে ওরা দেখতে পাচ্ছিল গ্যালারিতে দেশলাই জ্বালানো আগুনের শিখা। প্রেসবক্সে এক সাংবাদিক তো রেগে বলেছিল, ‘অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানরা যদি আপিল না করে তো আমিই করব। আমি নিজের লেখাই দেখতে পাচ্ছি না।’
অন্ধকারে ডন প্রায় তিন ঘণ্টা ব্যাট করে ১০৩ রান করে। এক সাংবাদিক লিখল, ‘পিকাডিলিতে মোমবাতির আলোয়ও ডন শতরান করবে।’ পর পর ছয়টি টেস্টে হল ছয়টি শতরান। পরের টেস্ট ওভালে ডন ব্যাট করেনি এবং তারপরই আবার সেপর পর দুটি টেস্টে দুটি শতরান করে (১৯৪৬-৪৭ অস্ট্রেলিয়া)। লিডসে অস্ট্রেলিয়া ১৯ রানে এগিয়ে ২৪২ রানে ইনিংস শেষ করে। ইংল্যাণ্ডের দ্বিতীয় ইনিংস ১২৩ রানে শেষ হওয়ার পরই আবার আকাশে ঝঞ্ঝামেঘ দেখা দিল। ঝড়-বৃষ্টি এখনি শুরু হবে। ডন নির্দেশ দিল, পেটাও, রান তাড়া করো। ১০৫ রান সংগ্রহের জন্য ব্যাটসম্যানরা তাই শুরু করল। রান উঠছে উইকেটও পড়ছে। খেলা ধীরে ধীরে উত্তেজনায় কাঁপতে শুরু করল। প্রকৃতির সঙ্গে রেষারেষি করে ইংলিশ প্রতিরোধ ভেঙে জয় সম্ভব হবে কি হবে না। দুটি টেস্ট অমীমাংসিত, একটি পরিত্যক্ত, আর একটির খেলা বাকি, সুতরাং এই টেস্টের বিজয়ীর ‘রাবার’ হারাবার ভয় অন্তত থাকবে না। লিডসে জিতলে অস্ট্রেলিয়ার কাছেই ‘অ্যাশেজ’ থাকবে।
অস্ট্রেলিয়া জিতল পাঁচ উইকেটে ১০৭ রান তুলে। ম্যাচে ওরিলি পায় ১০ উইকেট ১২২ রানে। ডন করে ১৬ রান। শেষদিকে উত্তেজনা এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যে সেআর খেলার দিকে তাকাতেই পারছিল না। ডেসিং রুমে বসে কিছু-একটা কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য গাদা গাদা রুটি আর জ্যাম চিবোতে শুরু করে আর বাইরে থেকে একজন রিলে করে তাকে বলে যায় খেলার কী অবস্থা। এত নার্ভাস সেজীবনে হয়নি।
কিন্তু ওভালে ‘টাইমলেস’ শেষ টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল অকল্পনীয়, টেস্ট ইতিহাসের বিরাটতম পরাজয়—ইনিংস ও ৫৭৯ রানে। এমন বিপুল ইনিংস হার এখনও কোনো দেশের বরাতে জোটেনি।
এই ওভাল টেস্ট, হাটনের টেস্ট। ২২ বছরের ইয়র্কশায়ার ওপেনিং ব্যাটসম্যান ১৩ ঘণ্টা ২০ মিনিট (তখনকার উইকেটে থাকার রেকর্ড) ব্যাট করে বিশ্ব টেস্ট রেকর্ড স্থাপন করে ৩৬৪ রানের। আগের রেকর্ড ছিল ডনেরই ৩৩৪। বিশ্ব টেস্ট রেকর্ড হল সর্বোচ্চ ইনিংস রানের ও ইংল্যাণ্ড ৭ উইকেটে ৯০৩। (৫৮ বছর পর শ্রীলঙ্কা এই রেকর্ড ভাঙে ভারতের বিরুদ্ধে ৬ উইকেটে ৯৫২ রান করে।) পার্টনারশিপে ইংল্যাণ্ডের রেকর্ড হল—দ্বিতীয় উইকেটে হাটন-লেল্যাণ্ড ৩৮২ রান; ষষ্ঠ উইকেটে হাটন-হার্ডস্টাফ ২১৫ রান। তার নিখুঁত ইনিংসে হাটন শুধু ৪০ রানের মাথায় ফ্লিটউড স্মিথের বলে স্টাম্পিং সুযোগ দিয়েছিল। টেস্ট ইতিহাসের সবথেকে দামি সুযোগ!